বাংলাদেশ

‘ইচ্ছেমতো’ নিয়োগে আগেভাগেই বৈধতা

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ পুরোনো। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চেও বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দিতে চেয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু ৫ মার্চের ৫৩৭তম সিন্ডিকেট সভায় ওই ১৩ শিক্ষককে নিয়োগ দিতে অসম্মতি জানান সদস্যরা। ওই সময় সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী, এ কে এম মাঈনুল হক মিয়াজী ও মোহাম্মদ নাসিম হাসান। চলতি বছরের জুলাই মাসে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তাঁদের মেয়াদ শেষ হয়। পরে নতুন সদস্য নিয়োগ পান। নতুন সদস্যদের নিয়ে ৫৩৯তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত নিয়োগ বাতিলের সেই সিদ্ধান্ত খারিজ করা হয় এবং বিজ্ঞাপিত পদের বাইরের ১৩ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের জুনে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে খণ্ডকালীন ১২ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার পছন্দ, ছাত্রলীগের নেতা ও কয়েকজন শিক্ষকের সুপারিশে এসব নিয়োগ দেওয়া হয় বলে তখন অভিযোগ ওঠে।

এ ছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক ও বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেন নিয়ে পাঁচটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এসব ফোনালাপ ছিল উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের সঙ্গে দুজন নিয়োগ প্রার্থীর। ফোনালাপ ফাঁসের পর খালেদ মিছবাহুলকে উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারীর পদ থেকে তড়িঘড়ি করে সরিয়ে দেওয়া হয়। আহমদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে। কিন্তু এখনো কর্তৃপক্ষ কোনো মামলা করেনি।

অবশ্য নিয়োগে অনিয়ম ও সিন্ডিকেটে ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নয়। বর্তমান শিরীণ আখতারের আগে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর সময়ে ‘অস্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ায় ১৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। তাঁর মেয়াদের শেষ সময়ে বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত ১৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখন এসব নিয়োগের অনুমোদন হয় সিন্ডিকেটে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কমিটির অনুমোদন ছাড়া বঙ্গবন্ধু চেয়ার (গবেষণাকেন্দ্র) পদে নিজে গবেষকের দায়িত্ব নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন সাবেক উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর আগে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছিলেন অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আরিফ। তাঁর সময়ও বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে শিক্ষক নিয়োগের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তাঁর সময়ে নিয়োগ পাওয়া ২৭১ শিক্ষকের মধ্যে ৭১ জনই বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত।

অতিরিক্ত নিয়োগের বিষয়টি সমালোচনা করে সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী বলেন, অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের পরিপন্থী। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে পরিকল্পনা কমিটি ও নিয়োগ বোর্ডের আর প্রয়োজন হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিজেদের ইচ্ছেমতো নিয়োগ দেওয়ার জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, সংবিধি ও শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী কোন বিভাগে কতজন শিক্ষক দরকার হবে, তা নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিকল্পনা কমিটি। এরপর শূন্য পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনকারীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর এসব তথ্য পাঠানো হয় নিয়োগ বোর্ডে। বোর্ড প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয় এবং নিয়োগের সুপারিশ করে। পরে সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়।

সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য এ কে এম মাঈনুল হক মিয়াজী বলেন, অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা সিন্ডিকেট সদস্যদের নেই। পরিকল্পনা কমিটি কিংবা নিয়োগ বোর্ড বিজ্ঞপ্তির আলোকে কাজ করেছে কি না, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কেউ নিয়োগ পাচ্ছে কি না, তা-ই মূলত দেখভাল করবে সিন্ডিকেট।

শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও (ইউজিসি) আপত্তি রয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগের অনিয়ম, নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে ফোনালাপ ফাঁসসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে গত সোমবার ইউজিসির দুই কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছেন। তাঁরা তিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেন।

ইউজিসির সদস্য আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেই। চাহিদা অনুসারে অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন হলে আবার বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আর সিন্ডিকেট যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার নজির কোথাও নেই। দেশের অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সিদ্ধান্ত কখনো নেওয়া হয়নি।

যা বলছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা

বর্তমানে সিন্ডিকেটে সদস্য আছেন আটজন। অতিরিক্ত নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে সিন্ডিকেটের সদস্য সহ-উপাচার্য বেনু কুমার দে এবং সদস্য মহীবুল আজিজ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সিন্ডিকেটের সভাপতি শিরীণ আখতারের কার্যালয়ে একাধিকবার গেলেও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি। বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

আরেক সদস্য মোহাম্মদ আবুল মনছুর প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির কারণে অনেক বিভাগে শিক্ষক ও জনবল-সংকট দেখা দিয়েছে। নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবার নিয়োগ দেওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। লোকবলের কারণে অনেক বিভাগের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। তাই চাহিদা অনুযায়ী বিভাগের পরিকল্পনা কমিটি ও নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশে বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট। একই মন্তব্য করেন সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম।

সিন্ডিকেটের এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অনিয়মের নতুন পথ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও আইন বিভাগের অধ্যাপক জাকির হোসেন। তিনি বলেন, এত দিন লুকোচুরির মাধ্যমে নিয়োগে অনিয়ম করা হতো। সিন্ডিকেটের এমন সিদ্ধান্তের পর প্রকাশ্যে অনিয়ম করা যাবে। মূলত অনিয়মকে বৈধতা দিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।