স্বাস্থ্য বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে যোগাযোগের ভূমিকা অনেক বড়। স্বাস্থ্যের সাফল্যে যোগাযোগের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা কম শোনা যায়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে যে অগ্রগতি আজ দেখা যায়, তার পেছনে বড় ভূমিকা আছে স্বাস্থ্য যোগাযোগ বা হেলথ কমিউনিকেশনের। এই অগ্রগতির পেছনে কাজ করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা, একই সঙ্গে ছোট-বড় বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওর তৃণমূলের কর্মী বাহিনী। আর ভূমিকা রেখেছে দেশের গণমাধ্যম।
স্বাস্থ্য যোগাযোগের কাজ হলো উপযুক্ত ও যথাযথ তথ্য দেওয়া, যেন মানুষ স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষ তথ্য পায় বা করণীয় সম্পর্কে জানতে পারে টেলিভিশন দেখে, রেডিও শুনে বা সংবাদপত্র পড়ে। অন্য উৎসের মধ্যে আছে বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড, পোস্টার, ব্যানার, প্রচারপত্র ইত্যাদি। সরকারি-বেসরকারি তৃণমূলের মাঠকর্মীরা মানুষকে নিয়ে দলগত বৈঠক করেন, উঠান বৈঠক করেন। তাতে তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি করণীয় বিষয়ে বলা হয়। হাতে-কলমে অনেক কিছু শেখানো হয়।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও প্রথমা প্রকাশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিতব্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বইয়ে সরকারি সাতটি প্রতিষ্ঠান বা অধিদপ্তরের শাখা বা কর্মসূচির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যারা বহু বছর ধরে মানুষকে সঠিক তথ্য দিয়ে সামাজিক ও ব্যক্তিগত আচরণ পরিবর্তনে কাজ করে চলেছে। এগুলো হচ্ছে: স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আইইএম ইউনিট, কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার, যক্ষ্মা-কুষ্ঠ কর্মসূচি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি এবং অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।
সুবচন যেমন মানুষের মন ধরে রাখে, বিজ্ঞাপনের ভাষাও স্থায়ী দাগ কাটে, মানুষ ভোলে না। মানুষ তার আচরণ পরিবর্তন করে। স্বাস্থ্যে তা ঘটেছে।
আফজাল হোসেন, অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা
টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, নাটিকা, তথ্যচিত্র, পোস্টারের তথ্য-ছবি বা এ ধরনের যোগাযোগসামগ্রী তৈরিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কর্মসূচিকে বিভিন্ন সময় সহায়তা করেছে দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এসব কাজে যুক্ত থেকেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না বা এখনো পিছিয়ে নেই।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
স্বাধীনতার পরপরই দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে। সেই সময় মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) ছিল ৬.৩। অর্থাৎ একজন মা গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। এখন সেই সংখ্যা কমে ২.১ হয়েছে।
‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ স্লোগানটি বিজ্ঞাপন আকারে বিলবোর্ডে চোখে পড়ত, বাংলাদেশ বেতারেও শোনা যেত। মানুষ এর মর্মার্থ বুঝল। প্রয়োজনের সময় তার হাতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী তুলে দিলেন স্বাস্থ্যকর্মী।
বড়ি বা কনডমের উপকারিতা গণমাধ্যমেও যেমন প্রচার পেয়েছে, মাঠকর্মীরাও ঘরে ঘরে গিয়ে একই কথা বলেছেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার বেড়েছে। মোট প্রজনন হার কমেছে।
মানুষকে সন্তান কম নিতে বলা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বলা সহজ ছিল না। কুসংস্কার সামনে এসেছে, ছিল লোকলজ্জা। আজ আর তা নেই। ঘরের পাশের দোকানেই অনেক কিছু পাওয়া যায়। সময়ের পরিবর্তনে স্লোগানেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন এখন বলা হচ্ছে: ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।’
স্বাস্থ্য সন্ধান
‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’। এইচআইভি/এইডস বিষয়ে মানুষকে সজাগ ও সতর্ক করতে এই স্লোগান বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
খাওয়ার স্যালাইনের কথাও বলা যায়। এর উদ্ভাবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি)। এর উপকারিতা সম্পর্কে সারা দেশের মানুষকে জানানোর চেষ্টা চালায় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। স্বাস্থ্য বিভাগ বিলবোর্ড লাগায় জেলায় জেলায়, গ্রামগঞ্জে। ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখান: কী করে এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি দিয়ে সহজে স্যালাইন বানানো যায়।
জনপ্রিয় অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেন বলেন, ‘ইতিহাস বলে, বিজ্ঞাপন বা স্লোগান তথা যোগাযোগ স্বাস্থ্যে বা পরিবার পরিকল্পনার উন্নতিতে অবদান রেখেছে। বিজ্ঞাপন তার নিজস্ব ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছায়। সুবচন যেমন মানুষের মন ধরে রাখে, বিজ্ঞাপনের ভাষাও স্থায়ী দাগ কাটে, মানুষ ভোলে না। মানুষ তার আচরণ পরিবর্তন করে। স্বাস্থ্যে তা ঘটেছে।’