দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনালের কেনাকাটায় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সিন্ডিকেট। প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরির কাজ ৩৭ শতাংশ শেষ। এখন চলছে অভ্যন্তরীণ কেনাকাটা।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএবি) প্রকল্পের প্রতিটি পণ্যের মান ও গ্রেড স্পষ্ট করে দিলেও সিন্ডিকেট তা মানছে না। বিদেশ থেকে কেনার নাম করে প্রকল্পে ঢুকানো হচ্ছে মানহীন ও নিম্ন গ্রেডের পণ্য।
সিএএবি এসব দেখভালের দায়িত্ব যাদের দিয়েছে সেই কনসালটেন্টের অনেক সদস্য সিন্ডিকেটের পকেটে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
সিন্ডিকেটের চোখ এখন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দিকে। ইতোমধ্যে তারা প্রকল্পের ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে বেশ কিছু নিম্নমানের পণ্য দক্ষিণ কোরিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসে।
বিষয়টি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পর সব পণ্যের মান যাচাই বাছাই করা হয়। তাতে বেশির ভাগ পণ্য নিম্নমানের প্রমাণ হওয়ায় সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।
বেবিচকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সিন্ডিকেট এখন বেপরোয়া হয়ে পড়েছে প্রকল্পের লিফট, বৈদ্যুতিক কেবল, বৈদ্যুতিক সুইচ, ভাল্ব, টাইলস, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার, স্কেলেটর, স্ক্যানিং মেশিন, এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) ও স্যানেটারি আইটেমসহ বেশ কিছু নিরাপত্তা পণ্য তাদের পছন্দের দেশ ও কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করার জন্য।
অভিযোগ, ঠিকাদার ও কনসালটেন্টের বেশির ভাগ সদস্যও সিন্ডিকেটের পক্ষে। জানা গেছে, কোনো পণ্য ক্রয়ের কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য মাত্র ছয়জনের স্বাক্ষর লাগে। সিন্ডিকেটের পক্ষে এর চেয়ে বেশি সদস্য থাকায় যেকোনো কার্যাদেশ পেতে বেগ পেতে হয় না।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, থার্ড টার্মিনালের প্রতিটি পণ্যের মান ও গ্রেড স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সুইচ, ভাল্বসহ বেশ কিছু বৈদ্যুতিক পণ্য আনা হয়েছিল।
এগুলো যাচাই বাছাই করার পর দেখা গেছে সব নিম্নমানের। এ কারণে সব ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া একটি গ্রুপ নানাভাবে চেষ্টা করছে টার্মিনাল ভবনের লিফট ও স্কেলেটরসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইটেম কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে আনার।
আমরা বলে দিয়েছি ইরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডের বাইরে এসব পণ্য আনা হলে সেগুলো ফেরত পাঠানো হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা আছে পণ্যের মান নিয়ে কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিয়ে কোনো ছাড় নেই বলেও তিনি জানান।
জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বেবিচক, কনসালটেন্ট ও ঠিকাদারের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। জড়িত আছে বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানি ও তাদের স্থানীয় এজেন্ট।
বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য পুরো সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জানা গেছে, তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানির পণ্যসামগ্রী ছাড়া অন্য কোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থার্ড টার্মিনালে ঢুকতে পারে না।
দরপত্রে অন্য কোনো কোম্পানি নির্বাচিত হলেও তার ইশারা ছাড়া কার্যাদেশ পাচ্ছে না। বেবিচক ও প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে চরম আতঙ্কে ভুগছেন। শুধু তাই নয়, কোনো বিদেশি কোম্পানির প্রকল্পে কাজ পেতে হলে ওই প্রভাবশালী সদস্যকে নেপথ্যে লোকাল এজেন্ট (দেশীয় এজেন্ট) করতে হয়।
অভিযোগ আছে সম্প্রতি একটি বিদেশি কোম্পানি সংসদীয় কমিটির ওই সদস্যের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে লোকাল এজেন্ট করে বিপুল অঙ্কের টাকার বৈদ্যুতিক কেবল সরবরাহের কাজ পান। এ ছাড়া তার মালিকানাধীন একটি দেশীয় কোম্পানির কাছ থেকেও বিপুল অঙ্কের টাকার মানহীন কেবল ক্রয় করে।
নিম্নমানের হওয়ায় দীর্ঘদিন কেবলগুলো প্রকল্প এলাকায় পড়ে ছিল। বেবিচক পুরো কেবল ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সিন্ডিকেট সেগুলো অস্থায়ীভাবে প্রকল্পে ব্যবহার করে।
অভিযোগ উঠেছে, দেশে আন্তর্জাতিক মানের সরকারি-বেসরকারি কেবল কোম্পানি থাকলেও তাদের চেয়ে বেশি দামে বিদেশ থেকে নিম্নমানের কেবল ও বৈদ্যুতিক সামগ্রী আমদানি করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, এসব কেবল আমদানি করতে গিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকার ভ্যাট ট্যাক্সও পরিশোধ করছে বেবিচক। জানা গেছে, সম্প্রতি কার্যাদেশ দেওয়া এ ধরনের একটি কেবল আমদানির চালানে ১শ কোটি টাকার বেশি গচ্চা যাবে সরকারের।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন কেবলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে কঠোরতা আরোপ করেছে।
থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ ঠিকাদার সরকারের এই নির্দেশনা মানছে না। পারলে ইট-বালি, সিমেন্টও তারা বিদেশ থেকে আনার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, থার্ড টার্মিনালের জন্য গোপনে সিন্ডিকেট বিদেশি একটি কোম্পানির কাছ থেকে কেবল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এমনকি পুরো চালানের ভ্যাট-ট্যাক্সও দিচ্ছে বেবিচক। অথচ এর চেয়ে কম দামে সরকারি কোম্পানি ইস্টার্ন কেবল ও দেশীয় বিআরবি কেবল দিতে চাইলেও তাদের দাম বেশি বলে বাদ দিচ্ছে। দেশীয় কোম্পানির কেবল নিলে ভ্যাট-ট্যাক্সও দিতে হয় না। অভিযোগ মূলত ঘুস ও কমিশন বাণিজ্য করতে না পারায় আমদানির দিকে ঝুঁকছে সিন্ডিকেট।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, তিনি নিজেই ঠিকাদারকে বলেছেন, দেশে ইস্টার্নসহ বেশ কিছু ভালো মানের কেবল কোম্পানি আছে। বিদেশ থেকে আনার দরকার নেই। তিনি কোরিয়া থেকে আসা কেবলগুলোর মান যাচাই বাছাই করে দেখবেন বলেও জানান।
এর আগেও থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে নিম্নমানের কেবল ক্রয়ের অভিযোগ উঠেছিল। ভবনের নির্মাণকাজ শুরুর আগে দেশীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকার কেবল ক্রয় করা হয়। কেবলের রোলগুলো প্রকল্প এলাকায় পৌঁছার পর সেগুলো দেখে সবাই আঁতকে ওঠেন।
সেগুলো এতটাই নিম্নমানের ছিল যে পুরো কেবল ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সিন্ডিকেট এতটাই প্রভাবশালী ছিল পরবর্তীতে পুরো চালানই প্রকল্পের নির্মাণকাজে লাগানো হয়। উলটো এতে বাধা দেওয়ায় বেবিচকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে থার্ড টার্মিনালের মনিটরিং থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ওই চালানে বড় অঙ্কের টাকার আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের ফায়ার সেফটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে তার উলটো। এখানে ফায়ার সেফটিকে অগ্রাহ্য করা হয়। তার মতে, দেশে বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে।
শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমানবন্দরে টার্মিনালেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মূল উৎস ছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট। কিন্তু তার পরও থার্ড টার্মিনালের ফায়ার সেফটি নিয়ে নির্বিকার বেবিচক। কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্পে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হলেও তারা নির্বিকার। উলটো কনসালটেন্ট ফার্মের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
বেবিচকের নিয়োগকৃত কনসালটেন্ট ফার্মের কর্মকর্তা মাহতাব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের চুক্তিতে বাধ্যবাধকতা থাকায় কেবলসহ কিছু বৈদ্যুতিক পণ্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনতে হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানির কেবলের দাম বেশি হওয়ায় ঠিকাদার কম দামে বিদেশ থেকে পণ্য আনছেন।
কারণ আমদানি করা পণ্যের ট্যাক্স ভ্যাট দিচ্ছে সরকার। যদি সরকার ২৫ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট বাতিল করে দেয় তাহলে বিদেশি কোম্পানির পণ্য দেশে আসা বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণ ও বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দাম বাড়ার কথা বলে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে নিয়েছেন ঠিকাদার। তার পরও নিম্নমানের পণ্য সামগ্রী ক্রয় করার রহস্য কী? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কমিশন বা ঘুস বাণিজ্য।
২০১৯ সালের শেষে শুরু করা হয় এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ। শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের জুনে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। প্রথমে ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে প্রকল্প ব্যয় সাত হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়।
নির্মাণকাজে অর্থায়ন করছে জাইকা। জাপানের সিমুজি ও কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দুই দেশের চার শতাধিক দক্ষ জনবল কাজ করছেন প্রতিদিন।
জানা গেছে, কেনাকাটার জন্য প্রকল্পের মূল ঠিকাদার আরও দুটি প্রতিষ্ঠানকে সাব কনট্র্রাকটর নিয়োগ দিয়েছে। দুই সাব কনট্রাকটর আবার একাধিক সাব কনট্রাকটর নিয়োগ করে। যার কারণে কেউ কারও কথা শুনছে না। একটি পণ্য নানা ধাপে ক্রয় করতে গিয়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। সবাই লাভ করছে। গুণগত মান কেউ দেখছে না।