জাতীয়

সিনহা

সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ঘটনাক্রম

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা হয়েছে সোমবার। একনজরে সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিচারক্রম নিচে তুলে ধরা হলো।
১ আগস্ট ২০২০
সিনহার সঙ্গে তথ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত সাইদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় দুটি ও শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে রামু থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। সরকারি কাজে বাধা প্রদান ও মাদক আইনে অভিযোগ আনা হয় সিফাতের বিরুদ্ধে। শিপ্রার বিরুদ্ধে হয় মাদকের মামলা। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে আলোচনার মধ্যে ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ২০ জন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

২ আগস্ট ২০২০
ঘটনা তদন্তে ১ আগস্ট গঠন করা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি পরদিন পুনর্গঠন করা হয়। যুগ্মসচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ওই কমিটিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রতিনিধিত্বও রাখা হয়।

৪ আগস্ট ২০২০

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় জানায়, সিনহার মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

৫ আগস্ট ২০২০
২০২০ সালের ৫ আগস্ট টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ নয়জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালত মামলাটি নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন। এ মামলার পাশাপাশি পুলিশের দায়ের করা তিন মামলারও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র‌্যাবকে।

৫ আগস্ট ২০২০
সিনহা নিহত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনার মধ্যে কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও আইজিপি বেনজীর আহমেদ। ঘটনাস্থল শামলাপুর চেকপোস্ট এলাকা পরিদর্শনেও যান তারা।

৫ আগস্ট ২০২০
ব্যাপক আলোড়নের মধ্যে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে করে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। সেখানে সিনহা নিহতের ঘটনায় দায়ী সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতারের দাবি তোলেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা।

৬ আগস্ট ২০২০
এদিন সকালে মামলাটি নথিভুক্ত করে টেকনাফ থানা। বিকালে মামলায় এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্যে ওসি প্রদীপসহ সাতজন পুলিশ সদস্য আদালতে আÍসমর্পণ করেন। বাকি ছিলেন এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। প্রদীপ-লিয়াকতসহ তিনজনকে রিমান্ডে পাঠান আদালত।

৭ আগস্ট ২০২০
ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত, এসআই নন্দলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ।

৯ আগস্ট ২০২০
আদালত থেকে জামিন পেয়ে গ্রেফতারের নয়দিন পর কক্সবাজার কারাগার থেকে মুক্ত হন সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ।

১০ আগস্ট ২০২০
শিপ্রার মুক্তির পরদিন দুই মামলায় জামিন পেয়ে কক্সবাজারের কারাগার থেকে মুক্তি পান সিনহার সহযোগী সাইদুল ইসলাম সিফাত।

১১ আগস্ট ২০২০
তদন্ত চলার মধ্যে এদিন পুলিশের দায়ের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব।

১৩ আগস্ট ২০২০
সিনহা নিহতের ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ‘অপপ্রচার’ চালিয়ে সেনা-পুলিশ মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বিবৃতি দেয় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনাটিকে অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে পুলিশ কর্মকর্তাদের সংগঠনটি বলেছে, অপকর্মের জন্য দায়ী ব্যক্তির শাস্তি হবে, ব্যক্তির কোনো অপকর্মের দায় পুলিশ নেবে না।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলী

১৮ আগস্ট ২০২০
প্রথম দফায় সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় ওসি প্রদীপকে। মোট চার দফায় তাকে টানা ১৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার রাতে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এএসআই শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলে র‌্যাব।

৩০ আগস্ট ২০২০
হত্যায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিজের ও অন্যদের ভূমিকা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন তিনি। আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
হত্যা মামলায় কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনকে আসামি হিসাবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেন সিনহার বোন মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস, যা খারিজ করে দেন আদালত।

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
তদন্ত চলার মধ্যে এজাহারের বাইরে থাকা কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে র‌্যাব।

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
সিনহা হত্যার পর আলোচনায় থাকা কক্সবাজারের এসপি মাসুদ হোসেনকে কক্সবাজার থেকে বদলি করে রাজশাহী জেলায় পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তর।

১৩ ডিসেম্বর ২০২০
প্রদীপ-লিয়াকতসহ মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম। পাশাপাশি সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে তিন মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে র‌্যাব জানায়, অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিলেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে।

২১ ডিসেম্বর ২০২০
অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা।

২৪ ডিসেম্বর ২০২০
শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে রামু থানায় মাদক আইনের মামলায় র‌্যাবের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আপত্তি জানায় পুলিশ।

৩১ ডিসেম্বর ২০২০
ঘটনার পরপর পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সিফাত ও শিপ্রাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন বিচারক।

২৪ জুন ২০২১
পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আÍসমর্পণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান।

২৭ জুন ২০২১
১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক। সেই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন।

২৩ আগস্ট ২০২১

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আগের ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এদিন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আদালতে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্য ও জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।

৬ ও ৭ ডিসেম্বর ২০২১
ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন আসামিরা।

৯ জানুয়ারি ২০২২
চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আদালতে আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়, যা চলে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত।

১২ জানুয়ারি ২০২২
যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৩১ জানুয়ারি দিন ঠিক করে দেন বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।

৩১ জানুয়ারি ২০২২
মামলার রায় ঘোষণা। রায়ে প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে ফাঁসি ও নন্দ দুলালসহ ৬ জনকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়। সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়।