দৈনিক যুগান্তর এমন এক সময়ে তার ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে, যখন সাংবাদিকতা-বিশেষ করে মুদ্রিত মাধ্যমের সাংবাদিকতা এক কঠিন সময় পার করছে। একটা সময় ছিল, যখন মানুষ সকালটা শুরু করত খবরের কাগজ পড়ে। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও মফস্বল শহরগুলোয় প্রতিদিনের কাগজ পৌঁছাত বিকালে, তারপরও পাঠক ভাবত, দিনের খবরগুলো দিনের ভেতরেই পড়া হয়ে গেল। খবরের কাগজ ছিল সাদা-কালো, পৃষ্ঠা সংখ্যাও আটের বেশি থাকত না, এক সাহিত্য সাময়িকী ছাড়া অতিরিক্ত কোনো পাতাও থাকত না, ক্রোড়পত্র ছাপা হতো কালেভদ্রে। কিন্তু খবরের কাগজগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, হলুদ সাংবাদিকতা ছিল না, সম্পাদকদের একটা আলাদা সম্মান থাকত সমাজের কাছে। সাংবাদিকদের অবশ্য কাজ করতে হতো নানা বিধিনিষেধের বেড়াজাল পার হয়ে, বাঁকা-চোরা বিধিবিধান ও আইনের ফাঁক গলিয়ে।
সময়টা মুদ্রণমাধ্যম থেকে দৃশ্যমাধ্যমে ঢুকে পড়লে আমাদের চেনা জগতের অনেক কিছুই পালটে গেল। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় খবর দেখানো শুরু হলে মুহূর্তের খবর মুহূর্তেই প্রচার হওয়ার সুযোগ এসে গেল, বিশেষ করে ব্রেকিং নিউজ বা তাজা খবরের প্রাপ্তি সহজ হলো। তারপর যখন ইন্টারনেটের যুগ এসে গেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একদিকে ‘সিটিজেন জার্নালিস্ট’ কথাটার প্রতিষ্ঠা দিল-অর্থাৎ একটা স্মার্টফোন যার হাতে, তিনিই নামতে পারেন সাংবাদিকের ভূমিকায়। নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন, গ্রামের সমাজপতি ও ক্ষমতাশীলদের অনেক অন্যায় ও অপরাধ, ঘুস ও দুর্নীতির মতো নানা অপকীর্তির ভিডিও প্রচার শুরু হলে সেসবের প্রতিকারের জন্যও মানুষ এগিয়ে এলো।
অন্যদিকে বানানো খবর, রটনা এবং গুজব প্রচারেরও একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়াল ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম অথবা টুইটার। একইরকম, অনলাইন সাংবাদিকতাও তার ভালোমন্দ নিয়ে হাজির হলো। যেসব প্রতিষ্ঠিত কাগজের, যেমন যুগান্তরের, অনলাইন সংস্করণ আছে, তারা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সাংবাদিকতার কাজগুলো করে যেতে থাকল। যেহেতু অনলাইন সংস্করণের পরিসর অসীম, অসংখ্য ছবি ও ভিডিও সংযুক্ত করা যায়, প্রতিদিন ওই কাগজের একটা সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় সম্পূরক হিসাবে সেসব দাঁড়িয়ে গেল। আর প্রতিমুহূর্তে খবর হালনাগাদ করার সুযোগ তো থাকলই। বিপরীত দিকে, বেশকিছু অনলাইন সংস্করণ পাঠক সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আশ্রয় নিল হলুদ সাংবাদিকতার, রগরগে সংবাদ পরিবেশনার।
তারপরও বিশ্বব্যাপী যেমন, বাংলাদেশেও তেমন, কাগজে ছাপা সংবাদপত্র এখনো তার অবস্থান হারায়নি। এর কারণ আমার মতে তিনটি, তবে এক্ষেত্রে যারা গবেষণা করছেন, তারা আরও কিছু কারণ খুঁজে বের করতে পারবেন-
ক. আমাদের জাতিগঠনে, গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রূপায়ণে সংবাদপত্র ঐতিহ্যগতভাবে যে প্রভাব রেখেছে, তারই ধারাবাহিকতায় এখনো মানুষ ছাপানো সংবাদপত্রকে মূল্য দেয়। বলা যায়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে যা কিছু ভালো, তা টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের আগ্রহের এটি একটি বহিঃপ্রকাশ;
খ. আমাদের প্রতিদিনের জীবনে মোটাদাগে যেসব ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে-তা রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য অথবা অপরাধ, যাই হোক-সেসবের একটা বিশ্বস্ত প্রতিফলন এবং সেসব নিয়ে ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলোর যে ভূমিকা, ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলো তাৎক্ষণিকভাবে এবং বিরামহীনভাবে সেসব করে গেলেও সেই ভূমিকায় এখনো যেতে পারেনি; অথবা বলা যায়, সংবাদপত্রের কথাগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তুলে ধরে একটা সহযোগী বা পরিপূরক ভূমিকায় তারা নামে। মূল সুরটি এখনো সংবাদপত্রই বাজিয়ে যাচ্ছে; এবং
গ. ইলেকট্রনিক মাধ্যমের চরিত্রই হচ্ছে চলমানতা, অর্থাৎ মুহূর্তে মুহূর্তে এর দৃশ্যপট পালটায়। প্রযুক্তি হয়তো একসময় আমাদের সবাইকে ওই জায়গায় নিয়ে যাবে যখন এ চলমানতা, এ গতির বেগ, আমাদের চিন্তাভাবনা, জীবনচর্চা এবং কাজ-এমনকি অবসরের বিষয়গুলোকে সংজ্ঞায়িত করবে। সে পর্যন্ত এ চলমানতা থেকে একটু রেহাই পেতে মানুষ যতির আবেগ খুঁজবে, সংবাদপত্রের সুস্থির অক্ষর আর হাতে নিয়ে তা পড়ার বাস্তবকে মানুষ স্বাগত জানাবে। সেজন্য খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পড়া চিন্তার ও চোখের সুস্থিরতার কাছে ফিরে যাওয়ার নামান্তর। তবে সংবাদ মুদ্রিত হোক, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের হোক, তার গুরুত্ব, গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাব নির্ভর করে সাংবাদিকদের ওপর এবং তাদের যারা সহায়তা করেন, তাদের ওপর। এ বৃহৎ পরিবারকে যদি সংবাদকর্মী হিসাবে আখ্যায়িত করি, তাহলে দেখা যাবে তাদের পেশা ও সংবাদপত্রের অস্তিত্ব-দুই-ই একটা সংকটে পড়েছে।
কাগজের দাম বাড়ছে, বিজ্ঞাপন কমছে, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ার অনুপাতে সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে না। সদিচ্ছা থাকলেও সংবাদপত্রগুলো ওয়েজবোর্ডগুলোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সাংবাদিকদের এক বড় অংশ কাজ করেন কম বেতনে, সুযোগ-সুবিধাও তাদের সীমিত। চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই। অনেক সংবাদপত্রের মালিক সেগুলোকে ব্যবহার করেন নিজেদের প্রচারের জন্য, তাদের কাজেও হস্তক্ষেপ করেন। ফলে সাংবাদিকতার পেশাটি এখন অনেকটাই আকর্ষণ হারাচ্ছে, মেধাবীরা তেমন এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন না। সমাজ ও দেশের জন্য এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়, কারণ সক্রিয়, অংশগ্রহণমূলক, বহুমত ও পথের সম্মিলনে সৃষ্ট গণতন্ত্রের উপস্থিতি থাকুক আর না-ই থাকুক, সংবাদপত্রই একটা সমাজের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটায়, নাগরিকের অধিকার ও মুক্তচিন্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে; অন্যায়-অবিচার এবং অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র কখনো খুব মজবুত নয়, সরকারগুলো মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তার পক্ষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এমন কথা বলা যাবে না। তাছাড়া অনেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, যেমন আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত বাহিনীগুলো, কখনো তাদের বিরুদ্ধে যায় এমন খবর ছাপা (বা প্রচারিত) হতে দিতে চায় না। ফলে সেই পুরোনো বিধিনিষেধ, আইনকানুন এখনো চলছে। এখনো সাংবাদিকদের ধরপাকড় করা হয়। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, অপকীর্তি ছাপা হলে সাংবাদিকদের ওপর খড়গ নেমে আসে। এমনকি কার্টুন যারা আঁকেন-বিদেশে যাদের সম্মানের চোখে দেখা হয়-তারাও বিপদগ্রস্ত। এক কার্টুনিস্ট এখন তো জেলেই আছেন। এর বাইরে আছে আইসিটি আইনের মতো খড়গ। তাছাড়া নানা উগ্রপন্থি গোষ্ঠী, মাদক ব্যবসায়ী এবং বড় মাপের অপরাধীরাও সাংবাদিকদের নিশানা করে রাখে। এত বাধা পেরিয়ে সাংবাদিকরা কাজ করে যান, এটিই বিস্ময়ের ব্যাপার।
একটি দেশের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটুকু, তা-ই বলে দেয় দেশটির সংস্কৃতির মান কত উঁচু। আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আমরা গর্ব করি, কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে সেই গর্বটা করতে পারি না। আমি অবশ্য আশাবাদী। আমাদের অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে, শিক্ষার বিস্তার ঘটছে। এ দেশের মানুষ গতিশীল, উদ্যমী। তাছাড়া দেশটির মূল শক্তি তারুণ্য। আজ না হোক কাল আমাদের অনেক চর্চায় পরিবর্তন আসবে। সাংবাদিকতায়ও। সেজন্য সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের তাদের গতিশীলতা, সাহস ও নিষ্ঠা ধরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে যুগান্তর আছে কাঙ্ক্ষিত এক ভূমিকায়। এর আত্মপ্রকাশের সময় থেকেই আমার পছন্দের তালিকায় যুগান্তর রয়েছে। দিনে দিনে এটি পাঠকদের কাছে আরও প্রিয় হচ্ছে। যুগান্তর যে সফল একটি সংবাদপত্র তার কারণ সত্য প্রকাশে কাগজটি সাহস দেখিয়ে এসেছে, মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এর কলামগুলো নানা মত ও চিন্তাকে ধারণ করে, যা গণতন্ত্রের একটি মূল শর্ত। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের যেসব অঞ্চলে দৃষ্টিপাত করে গঠনমূলক আলোচনা, মতের আদান-প্রদান ও সময়ের দাবি মেনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চার বিষয়গুলো নিশ্চিত ও উৎসাহিত করা প্রয়োজন, যুগান্তর তা-ই করছে। বাইরের, অর্থাৎ পাঠকের দাবিগুলো মেটানোর পাশাপাশি পত্রিকাটি তার ঘরের দাবিগুলোও মেটাচ্ছে।
কোভিডকালে এতে চাকরি বিয়োগের ঘটনা ঘটেনি বলে শুনেছি। নিজের পরিবারের প্রতি যে কাগজ মনোযোগী, তার চিন্তাটা স্বচ্ছ হবে, এর সাহসটাও থাকবে, এ কথা বলাই যায়। যুগান্তরের ২৩ বছরে পদার্পণে আমি এর সম্পাদক, প্রকাশক এবং সব সাংবাদিকসহ এর পরিবারের সবাইকে অভিনন্দন জানাই। যুগান্তর এগিয়ে যাক, আর আমাদের সাংবাদিকতা আরও গতিশীল ও সমুন্নত হোক, এ রকমটা আশা করি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষাবিদ ও লেখক