নজরুল লিখেছিলেন, ‘দেখব এবার জগৎটাকে কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে’। এই একটা কথাই ঘুরিয়ে বলেছিলেন বিশ্বকবি-‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও তারই রথ নিত্যই উধাও’। বিশ্বকবি মহাকালের যে যাত্রার ধ্বনিকে ‘উধাও’ হতে দেখেছেন, নজরুল তাকে দেখেছেন যুগান্তরের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরতে। ঢাকার দৈনিক ‘যুগান্তর’ যুগান্তরের এই ঘূর্ণিপাককেই বাস্তব জগতে তুলে ধরেছে নিপুণভাবে গত বাইশ বছর ধরে। ‘যুগান্তর’ আজ বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ জাতীয় পত্রিকা। এ পত্রিকার মালিক শিল্পপতি নুরুল ইসলাম করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু তার আদর্শের ও স্বপ্নের যুগান্তর এখনো রয়ে গেছে তার স্ত্রী-পুত্র এবং সাংবাদিকদের সমবেত প্রচেষ্টায়। শিল্পপতি নুরুল ইসলামের পত্নী সালমা ইসলাম যোগ্যতার সঙ্গে কয়েক বছর পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন। এরই মধ্যে তিনি প্রতিমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব বহন করেছেন। আবার আইনজীবীও। এত দায়িত্ব বহন করা সত্ত্বেও তিনি যুগান্তরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। স্বামীর স্বপ্নের পত্রিকাটিকে মরতে দেননি।
আজ যুগান্তর তেইশ বছরে পা দিচ্ছে-এটি কম গৌরবের কথা নয়। বর্তমান সম্পাদক সাইফুল আলম আজ যুগান্তরের সৎ সাংবাদিকতার ‘ঐতিহ্য’ শুধু ধরে রাখেননি, তাকে উন্নতও করেছেন।
যুগান্তর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। সত্য খবর প্রকাশ করতে গিয়ে শিল্পপতি নুরুল ইসলামকে জেল-জুলুম ভোগ করতে হয়েছে। তবু তিনি আপস করেননি।
যুগান্তর তার স্বপ্নের আপসহীন পত্রিকা এবং এখনো বেঁচে আছে। আমার ধারণা, যুগান্তর যেভাবে পাঠকপ্রিয় হয়েছে তাতে আশা করা যায়, পত্রিকাটি দীর্ঘায়ু হবে এবং যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকের সব খবর বাংলাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারবে।
যুগান্তর নামটি আমি পছন্দ করি এ কারণে যে, বহুকাল আগে দুই বাংলার বিখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে দৈনিক যুগান্তর বেরিয়েছিল। বাংলাদেশ তখনো ভাগ হয়নি। যুগান্তর ছিল আমাদের প্রিয় পত্রিকা। আমি তখন কিশোর। যুগান্তরে ছোটদের ‘পাততাড়ি’ বিভাগটি ছিল আমার পরম প্রিয়। কলকাতার যুগান্তর এখন নেই। কিন্তু ঢাকার যুগান্তরের মধ্যে আমার কিশোরকালের প্রিয় পত্রিকাটির গন্ধ পাই।
বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্র একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা নয়। এখন এটি একটি বড় শিল্প এবং এ শিল্প প্রতিষ্ঠায় কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। আগেকার দিনের মতো অল্প খরচে পত্রিকা প্রকাশ করা যায় না। মুশকিল হয়েছে, এ সত্যটি অনুধাবন না করে বাংলাদেশে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তারা পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
শিল্পপতি নুরুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক জার্নালিজমের ক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টি করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন একটি অত্যাধুনিক টেলিভিশন হিসাবে খ্যাত। তিনি আজ বেঁচে থাকলে হয়তো যুগান্তরের আরও সম্প্রসারণ ঘটত। ঘটবে না একথা বলা যায় না। তার পরিবার যেভাবে পত্রিকা ও টেলিভিশন কেন্দ্রকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাতে জনপ্রিয়তার জোরে এদের আরও সম্প্রসারণ ঘটবে আশা করা যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতির এক সংকট মুহূর্তে যুগান্তরের আবির্ভাব। এ সংকট মুহূর্তের প্রতিটি ধাপ যুগান্তর সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছে। সে একদিকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা, বাকস্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তরের অবদান স্মরণীয়। বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী দেশ। তার অর্থনীতি উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের পর্যায়ে পৌঁছার দিকে এগিয়ে চলেছে। ঘরের এ শক্তি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রভাবশালী দেশে পরিণত করেছে। তাই বহির্বিশ্বের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও তাকে জড়িত হতে হচ্ছে। এই কাজে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কদের যারা সহযোগিতা জোগাচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম অগ্রসরমান পত্রিকা যুগান্তর। আবার জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অভিযোগ প্রকাশে পত্রিকাটি পিছপা নয়।
বাইশ বছর ধরে যুগান্তর দেশের সাংবাদিকতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে একেকটি মাইলফলক স্থাপন করেছে। ভবিষ্যতেও তা করে যাবে এটা আমি আশা করতে পারি। আমি পত্রিকাটির দীর্ঘজীবন কামনা করি এবং যুগান্তরের মালিক-সাংবাদিকসহ সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই।
৩০ জানুয়ারি ২০২২, লন্ডন