নতুন কোনো নাটকীয়তা না হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ‘বিদায় ঘণ্টা’ বাজতে চলছে আজ। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে প্রথমবারের মতো দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে বিদায় নিতে হবে।
বৃহস্পতিবার অনাস্থা ভোট খারিজ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করলে নতুন মোড় নেয় দেশটির অস্থিতিশীল রাজনীতি।
পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী আজ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য জাতীয় পরিষদের স্পিকার। ৩ এপ্রিলের আলোচ্যসূচির সঙ্গে মিল রেখে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই এই অধিবেশন শুরু করতে হবে।
সুপ্রিমকোর্টের আদেশে বলা হয়, ‘৩ এপ্রিলের কার্যসূচি অনুযায়ী হাউজের কার্যক্রম পরিচালনায় জাতীয় পরিষদের চলতি অধিবেশনে বৈঠক আহ্বানে স্পিকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে হওয়া উচিত, কোনোভাবেই শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার পরে নয়।’
ইমরান খান অবশ্য শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টাকে ‘রিজিম চেঞ্জ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার কথা অস্বীকার করে আসছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চাইছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আর ইমরান খানবিরোধী জন অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ক্ষমতা পরিবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘আপাত স্বস্তির’ বলেই মনে করছেন তারা।
৭ মার্চ জাতীয় পরিষদের সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় বিরোধী দলগুলো। এরপর ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্পিকার। প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির জন্য ৩ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়। ওই দিনের কার্যসূচিতে প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিসহ ছয়টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর ৩ এপ্রিল বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা দিয়ে খারিজ করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। একই সঙ্গে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন তিনি।
অনাস্থা ভোট খারিজের দিনই স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) শুনানি গ্রহণ করেন সুপ্রিমকোর্ট। টানা ৫ দিনের দীর্ঘ শুনানি শেষে অনাস্থা ভোট খারিজ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে বৃহস্পতিবার রায় দেন আদালত। একই সঙ্গে জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল করে শনিবার অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটগ্রহণের নির্দেশ দেন।
সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ করেছিলেন তা ছিল বেআইনি, এবং প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি এই লক্ষ্যে যে ঘোষণা করেন তাও ছিল অবৈধ।
বিবিসি উর্দু বলছে, আদালতের এই রায়ের অর্থ হলো বিরোধীদল শনিবার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর অনাস্থা ভোট করে তাকে পরাজিত করবে, এবং তাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে।
প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন, এই ভোটটি শনিবার হতেই হবে এবং কোন কারণ দেখিয়ে এই অধিবেশন মুলতবি করা যাবে না।
তবে শুরু থেকেই ইমরান খান তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিরোধী দলগুলোর চেষ্টাকে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে এর পেছনে মদদ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন প্রকাশ্যেই। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সাউথ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলছেন, ইমরান খান রাশিয়া ও চীনের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন এটি সত্যি, কিন্তু সেজন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরাতে চেষ্টা করছে কি-না তা এখনো পরিষ্কার নয়।
তিনি বলেন, ইউক্রেন হোক আর চীন হোক- পাকিস্তান বিষয়ে আমেরিকা আসলে কতদূর যাবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
অর্থনীতিকে সঠিক পথে আনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন ইমরান খান। জনগণের একাংশের কাছে তার জনপ্রিয়তা এখনো অটুট থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন হারাতে শুরু করেন ইমরান।
মূলত মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত বেড়ে চলা এবং বিদেশি ঋণের বোঝা তাকে সংকটে ফেলে দেয়। ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাধ পূরণ হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে টানাপড়েন শুরু হলে তার বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, বর্তমান সংকটের শুরু অক্টোবরে, যখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নতুন প্রধানের নিয়োগপত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সামরিক বাহিনীর পছন্দ করা ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে বাধ্য হন, কিন্তু ততক্ষণে মাঠ অনেকটা বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
আবার রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করলো তখন তার মস্কো সফরও পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ভালো ভাবে নেয়নি।
এর মধ্যেই তার ক্ষমতাসীন জোটের বড় অংশ এমকিউএম তাকে ছেড়ে বিরোধী জোটে যোগ দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারায় তার সরকার।
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ১৭৩ জন সদস্যের সমর্থন দরকার হয়। যদিও বিরোধীদের পক্ষে এখন ১৭৭ জনের সমর্থন আছে।
এটি বুঝতে পেরেই শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আটকে দিয়ে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে আগাম নির্বাচনের পথে অগ্রসর হন তিনি।
কিন্তু এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব- চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ইমরান খানের সামনে আর কোন পথ খোলা রইলো না।
যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখছে?
মার্চের শেষে এক সমাবেশে একটি চিঠি দেখিয়ে ইমরান খান বলেছিলেন তার বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব একটি ষড়যন্ত্র এবং এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নামও উল্লেখ করেন।
তার অভিযোগের জবাবে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায় যুক্তরাষ্ট্র। অনাস্থা প্রস্তাবের সঙ্গে তাদের কোনও ধরনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেশটি।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয় ইমরান প্রশাসনের।
তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কতটা উদ্বিগ্ন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলে মনে করেন অনেকেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, বিশেষ করে আফগানিস্তানে যতদিন মার্কিন সৈন্য ছিলো ততদিন পাকিস্তানের ওপর তাদের এক ধরনের নির্ভরতাও ছিলো।
আবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আছে আগে থেকেই, কারণ দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আছে।
এসব মিলেই সম্পর্ক এতদিন একভাবে চললেও দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এখন নতুন কিছু চিন্তা করছে এবং চীনের সঙ্গে টানাপোড়েন অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ওপর।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের মৈত্রী। কিন্তু সেটি যে পর্যায়ে গেছে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য অনুকূল নয়। এটা যে আবার পাকিস্তানের সবাই গ্রহণ করছে তাও নয়। এ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। তবে ইমরান খান যে অভিযোগ করেছেন তা প্রমাণিত নয়।
পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধিতা আছে এবং ইমরান খানসহ রাজনীতিকরা নানা সময়ে সেটা ব্যবহার করেছেন- এসব বিষয় বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র দূরত্ব বজায় রাখছে আবার কৌশলগত কারণে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রাখা জরুরি সেটাও তারা বুঝতে পারছে বলে মনে করেন তিনি।
ইমরান খান দাবি করছেন, তিনি যেহেতু সম্প্রতি মস্কো সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন, এবং এর আগে বিভিন্ন সময়ে আমেরিকার ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের’ সমালোচনা করেছেন, সেজন্যে তাকে সরানোর ষড়যন্ত্র চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র এসবের সত্যতা অস্বীকার করলেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ দেশটিতে মার্কিনবিরোধী মনোভাবের কারণে, যা যুক্তরাষ্ট্রেরও জানা আছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ যখন এলো তখন দেখা গেলো ইমরান খান রাশিয়ার দিকে। সেটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর। তবে এককভাবে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে হয়নি। আর ইমরান খান প্রায়শই মার্কিনবিরোধী কথা বলেন। কারণ তিনি জনতুষ্টিবাদী নেতা। এসব মিলেই চলমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তার মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে তবে ভারত-চীন ইস্যুসহ নানা কারণে তাদের ভিন্ন চরিত্রও দেখা যেতে পারে।
অবশ্য ড. শফিকুর রহমান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর নজর রাখছে এটা ঠিক, কিন্তু এ নিয়ে খুব বেশি কিছু তারা করবে না।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আর এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যতটা ব্যস্ত সেখানে পাকিস্তান নিয়ে তাদের অতটা ভাবারও সুযোগ নেই। বাইডেন প্রশাসনের উপর মহল থেকে তাই তেমন কোন আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না।
তার মতে, নিজের স্বার্থেই আমেরিকার ইস্যুটি সামনে এনেছেন ইমরান খান আর আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গিতে তার খুব একটা গুরুত্ব নেই।
তিনি বলেন, আমেরিকার কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। এটা তো নিশ্চিত পাকিস্তানে যা হতে চলেছে সেটি আমেরিকা প্রলুব্ধ না করলেও তার পক্ষেই যাচ্ছে। আমি মনে করি সে কারণেই পাকিস্তান নিয়ে খুব বেশি চিন্তা তারা করছে না।
শফিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বরাবরই ভালো এবং সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে এতদিনকার সুসম্পর্ক আর ইমরান খানের নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা