আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এডিপির আকার হচ্ছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশটি তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দ নির্ধারণসহ অনুমোদন প্রক্রিয়া, এমনকি বাস্তবায়ন পর্যায়ে তদারকির দায়িত্বও এই মন্ত্রণালয়ের। ফলে বাজেটে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও কমিশন। এর নেতৃত্বে আছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেছেন, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে যত ধরনের অস্ত্র আছে তার সবই আগামী বাজেটে ব্যবহার করা হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-হামিদ-উজ-জামান
যুগান্তর : আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হবে?
এমএ মান্নান : ভালো বাজেটই হবে। বাজেটটি চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আজকের যে বাংলাদেশের অবস্থান এর মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা শাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সঠিক নেতৃত্ব। করোনা মহামারির মতো দুর্যোগে টিকে থাকাটা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার ছিল। কোভিডের মধ্যে উন্নয়ন ধরে রাখাটা একটা মুনশিয়ানা ব্যাপার। আশা করছি সেই মুনশিয়ানাটা আগামী অর্থবছরের বাজেটেও দেখাবেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছর ভালো যাবে। কারণ চলমান কয়েকটি মেগা প্রকল্প শেষ হয়ে যাবে। যেমন পদ্মা সেতু জুন মাসেই খুলে যাবে। এছাড়া মেট্রোরেল ৪-৫ মাসের মধ্যে প্রথম অংশ চালু হবে। বঙ্গবন্ধু টানেল ৫-৬ মাসের মধ্যেই খুলে যাবে। এই প্রকল্পগুলোর প্রতিটি থেকে উচ্চ রাজস্ব আয় হবে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসবে। চলমান অন্য প্রকল্পগুলোরও বাস্তবায়নে গতি বাড়বে।
যুগান্তর : মূল্যস্ফীতি কীভাবে সামলাবেন?
এমএ মান্নান : মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত। ইংল্যান্ডে গত ৫০ বছরে যে মূল্যস্ফীতি হয়নি এবার সেটি হয়েছে। আমি নিজেই লন্ডন ঘুরে এলাম। তাই এটা শুধু বাংলাদেশের ব্যাপার নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে আছে। এর চাপ সামলাতে যত ধরনের অস্ত্র আছে তার সবই ব্যবহার করা হবে। ইতোমধ্যেই কিছু কিছু ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন মুদ্রা সরবরাহের লাগাম টানার উদ্যোগ আছে। এছাড়া আমদানি-রপ্তানির বিষয়গুলো বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে। কোন পণ্যের ওপর কেমন শুল্ক আরোপ করা যায়, কোনগুলোতে ছাড় দেওয়া যায় বাজেটে এসব বিষয় দেখা হবে।
যুগান্তর : নিত্যপণ্যের দাম কমাতে বাজেটে কী ধরনের উদ্যোগ থাকতে পারে।
এমএ মান্নান : নিত্যপণ্য যেমন-চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন ও আদাসহ অন্যান্য পণ্যের দাম যাতে সহনীয় থাকে সে বিষয়টি অবশ্যই বাজেটে বিবেচনা করা হবে। এসব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বা বায়বীয় সব ধরনের করের বিষয়গুলো দেখা হবে। বাজার মসৃণ করা হবে। যেমন রাস্তাঘাটে ট্রাক আটকিয়ে চাঁদাবাজি করা হয়। ফলে এর প্রভাব পড়ে পণ্যের দামে। আশা করছি আগামী বাজেটে এমন ধরনের নানা বিষয় নজরে রাখবেন অর্থমন্ত্রী।
যুগান্তর : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে কিছু বলুন।
এমএ মান্নান : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিষয়ে বলার আগে একটা ব্যক্তিগত মত তুলে ধরছি। এটি হলো ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা আরও বাড়ানো উচিত। এক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত সীমা নির্ধারণ করা দরকার। বিষয়টি অর্থমন্ত্রী ভেবে দেখতে পারেন। আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরও প্রসারিত হবে। এর আওতায় দেওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়ানোর পক্ষে আমি। প্রধানমন্ত্রী যদিও মনে করেন এটা তো কোনো বেতন নয়, গরিব মানুষদের জন্য একটু সহায়তা। তবে তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমার মত হলো ঢালাওভাবে প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেওয়ার বিষয়টি একটু ভেবে দেখতে হবে। কেননা সব প্রতিবন্ধী পরিবারের অর্থের প্রয়োজন নেই। তবে যারা গরিব বা সত্যিই যাদের প্রয়োজন তাদের অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া দরকার।
যুগান্তর : এবার এডিপিতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন খাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছেন?
এমএ মান্নান : আগামী অর্থবছর পরিবহণ ও যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষি এবং গৃহায়ন ও কমিউনিটি খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি এক বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো বলেই বসলেন বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়ায় তিনি খুশি হয়েছেন।
যুগান্তর : মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছেন কোনগুলো?
এমএ মান্নান : আমরা অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে তারপরই বরাদ্দ নির্ধারণ করেছি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৫ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। এরপরই রয়েছে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ ৩১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ ২৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১৬ হাজার ১১ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ১৪ হাজার কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ ৯ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে ৭ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা।
যুগান্তর : উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা?
এমএ মান্নান : অবশ্যই। প্রতিবছরই এই প্রচেষ্টা থাকে। আগামী অর্থবছর উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়িয়ে সার্বিক উন্নয়ন বাজেটের ব্যয় বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে বিশেষ তাগাদা দিয়ে বৈঠক করা হবে। সেই সঙ্গে আইএমইডি চলমান প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন অব্যাহত রাখবে। এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা বা জটিলতা থাকলে তা নিরসনে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে। ধীরগতির প্রকল্পের জন্য ডিও লেটার দেওয়া অব্যাহত থাকবে।
যুগান্তর : প্রকল্প সংশোধন রোধ করার কোনো উদ্যোগ থাকবে?
এমএ মান্নান : দেখুন প্রকল্প সংশোধন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সময় সংশোধন যে খারাপ হয় তা কিন্তু নয়। তবে অতি সংশোধন ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত কঠোরভাবে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও রয়েছে। তবে এ দেশে জমির সংকট একটি বাস্তবতা। মানুষ জমি ছেড়ে দিতে চায় না। ফলে মামলা-মোকদ্দমা করে উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এ রকম নানা বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। তবুও আমরা চাই যাতে নির্ধারিত মেয়াদেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
এমএ মান্নান : যুগান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।