আজকের পত্রিকা

চ্যালেঞ্জ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ

দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জে রয়েছে। বিশেষ করে বৈদেশিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আমদানি অনেক বাড়লেও ওইভাবে বাড়ছে না রপ্তানি। অন্য দিকে প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স) কমেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

এ কারণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অন্য দিকে অনেক আগে থেকেই দেশের কর আদায়ের কাঠামো দুর্বল। করোনার কারণে বেশ কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। এ অবস্থায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দিকনির্দেশনা জরুরি।

যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এসব কথা বলেন। তার মতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময়ে বিনিয়োগ বাড়ানো, রাজস্ব আয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বাজেটে অগ্রাধিকার খাত নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনির হোসেন।

যুগান্তর : আগামী অর্থবছরের বাজেটে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?

মির্জ্জা আজিজ : আগামী বাজেটে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। প্রথম কথা হচ্ছে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আনুপাতিক হারে বিশ্বে সর্বনিু। এমনকি নেপালে মাথা পিছু আয় আমাদের চেয়ে বেশ কিছুটা কম হওয়া সত্ত্বেও, তাদের রাজস্ব আয় জিডিপির ২২ শতাংশ। ভারতেও ২২ শতাংশের বেশি। ফলে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে না পারলে ব্যয় বাড়ানো কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এবার অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে অবকাঠামো, জ্বালানি এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম। যেহেতু আমরা বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে চাচ্ছি, সে কারণে রাজস্ব না বাড়লে ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হয় না। তাই রাজস্ব বাড়ানোর একটি দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত বৈদেশিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কারণ আমদানির মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যদিও রপ্তানি বেড়েছে। তবে আমদানি বেড়েছে অনেক বেশি। অন্য দিকে প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স) কমেছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এতে মুদ্রার বিনিময় হারের প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি মার্কিন ডলার ১০০ টাকা ছাড়িয়ে ছিল। এখনো তা ৯০ টাকার উপরে আছে। যদিও এটি রপ্তানিকারকদের জন্য ভালো। তবে সামগ্রিকভাবে তা দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। কিছু দিন আগেও আমাদের যে রিজার্ভ ছিল, তা দিয়ে ৭-৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। কিন্তু বর্তমানে যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। ফলে অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদনের শিল্পের কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করা যাবে না।

যুগান্তর : দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

মির্জ্জা আজিজ : সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে এপ্রিল মাসে এই মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ ছিল। যদিও কেউ কেউ বলছেন, মূল্যস্ফীতির তথ্য সঠিক নয়। বাস্তবে এই হার আরও অনেক বেশি। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মূল্যস্ফীতির পেছনে কিছু আন্তর্জাতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবীতে খাদ্যের সরবরাহ কমে গেছে। এরপর জ্বালানির দাম বেড়েছে। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি, ওই দেশেও মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ৭ শতাংশ হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তারা পলিসি রেট বাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কতটুকু কমানো যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বিশ্ববাজারের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এর আওতায় আনতে হবে। তবে এই সামাজিক নিরাপত্তা বণ্টনের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাদের পাওয়ার কথা তারা বঞ্চিত হয়। কিন্তু সামর্থ্যবানরা পেয়ে যায়। কোনো কোনো সময় এই সহায়তা তসরুফ হয়। এই সমস্যা দূরীকরণে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। বাজেটের আরেকটি সমস্যা হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন। অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে তা ৪০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। আর পরবর্তী তিন মাসে আরও ৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন করে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত দেখানো হয়। এখানে প্রশাসন যন্ত্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে তিরস্কার ও পুরস্কার উভয় থাকা উচিত।

যুগান্তর : আয় বাড়ানোর জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে।

মির্জ্জা আজিজ : বাজেট বাস্তবায়নের জন্য আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু প্রত্যেক বছর দেখা যায়, আয় ব্যয়ের যে লক্ষ্য থাকে সংশোধিত বাজেটে তার চেয়ে কমানো হয়। বাস্তবায়ন হয়, তারা চেয়ে আরও কম। বর্তমানে যে পরিমাণ টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) রয়েছে, কর দেয় তার চেয়ে অনেক কম। এ ক্ষেত্রে টিআইএন-ধারীদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অন্য দিকে ভ্যাটের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দোকানদাররা ভ্যাট দিতে চায় না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেই। ক্রেতারাও রসিদ নিতে আগ্রহী নয়। এ ছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছে। ইতোমধ্যে যারা করের আওতায় এসেছে তাদের কর নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে।

যুগান্তর : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও বাস্তবায়নের গুণগতমান বাড়াতে পরামর্শ কী?

মির্জ্জা আজিজ : এডিপিতে অনেক বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়। যার ফলে প্রকল্পগুলোতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে সময়সীমা দেওয়া হয়, পরবর্তীতে সময় বাড়ে। এতে ব্যয়ও বেড়ে যায়। এ বছর সরকার প্রকল্প কমানোর কথা বলছে। কিন্তু এরপর কিছু অনুমোদিত প্রকল্প এডিপিতে ঢুকে যায়। সবকিছু মিলে এডিপির জন্য আমাদের আরও বাস্তবধর্মী হওয়া উচিত। সামাজিক খাতগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুই খাতে জিডিপির অনুপাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা আশপাশে যেকোনো দেশের চেয়ে কম। তবে খরচের দিক থেকেও সমস্যা রয়েছে। কারণ প্রতি বছরই এখাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা অব্যবহৃত থাকে। ফলে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।

যুগান্তর : বিনিয়োগ বাড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ থাকা উচিত?

মির্জ্জা আজিজ : আমাদের অর্থনীতিতে অন্যতম সমস্যা হলো গত দশক পর্যন্ত বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির আনুপাতিক হারে ২২-২৩ শতাংশের মধ্যে স্থবির আছে। এটি বাড়ানো জরুরি। তবে এখানে ব্যবসায়ীরা সব সময় কর ছাড় চায়। কিন্তু রাজস্বের বাস্তবতায় কর মওকুফের খুব বেশি সুযোগ নেই। তবে কিছু সমন্বয় করা যেতে পারে। এর চেয়ে বড় কথা হলো বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বীজনেস (সহজে ব্যবসা করা সংক্রান্ত) সূচকে উন্নতি করতে হবে। বর্তমানে এখানে আমাদের অবস্থান ১৬৮ নম্বরে। অর্থাৎ ১৬৭টি দেশ আমাদের উপরে অবস্থান করছে। এখানে আরও উন্নতি করতে হবে। যদিও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) থেকে বিভিন্ন সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তার সুফল আমরা এখনো পাইনি। বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশ অনেক এগিয়ে। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের আরেকটি নির্দেশক রয়েছে। যা হলো সুশাসন নির্দেশক। সেখানে যেসব সূচকের ভিত্তিতে এই নির্দেশক তৈরি করা হয়, তার সবগুলোতে বাংলাদেশ পিছিয়ে। ফলে অর্থনৈতিক পরিবেশ বিনিয়োগবান্ধব করার জন্য সুশাসনে নজর দিতে হবে।

যুগান্তর : করোনায় বেশ কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। সে ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনে কী ধরনের পদক্ষেপ থাকা উচিত।

মির্জ্জা আজিজ : গত কয়েক বছরে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক হ্রাসের হার কিছু কমে আসছে। কয়েক বছর আগে ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমে আসছিল। বর্তমানে তা ১ দশমিক ২ শতাংশে আসছে। অন্য দিকে করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে সংখ্যা আরও বেড়েছে। এ কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো জরুরি।

যুগান্তর : মাথাপিছু আয় বাড়লেও বৈষম্য বাড়ছে। এটি কমাতে কী ধরনের পদক্ষেপ আশা করছেন?

মির্জ্জা আজিজ : দেশে অর্থনীতিতে বৈষম্য বাড়ছে। বৈষম্যসংক্রান্ত সূচক হলো গিনি সহক। এই সূচক দিয়ে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বোঝা যায়। এই সূচকের ০.৫ হলে বিপদসীমায় ধরা হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশের স্কোর ০.৪৮৯। অর্থাৎ আমরা বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এ ছাড়াও আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য বেড়েছে। দেখা গেছে রংপুরে দরিদ্র বেশি, আবার অন্য জায়গায় কম। অনেকে আশা করেন পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বৈষম্য কিছুটা কমবে। এর পরও বৈষম্য দূর করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

যুগান্তর : ২০২৬ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে নতুন কী চ্যালেঞ্জ আসছে

মির্জ্জা আজিজ : এলডিসি গ্রাজুয়েশনের ফলে আমাদের শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। সেখানে দরকষাকষি সুবিধা নিতে হবে। তবে সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেসব শর্ত, তার মধ্যে শ্রমিক অধিকার, ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ, সবুজ কারখানা করা এবং শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয় রয়েছে। এ ছাড়াও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে সমস্যা হবে। বৈদেশিক ঋণের সুদের হার বাড়বে এবং মেয়াদ কমার আশঙ্কা রয়েছে।

যুগান্তর : পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

মির্জ্জা আজিজ : দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর অঙ্কটা কী সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিস্কার, তা হলো অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ পাচার হয়। এগুলো বন্ধ করতে হবে। অন্য দিকে যেসব দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ ছাড়াও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া বন্ধ করা উচিত। কারণ একবার সুযোগ দিলে তারা বারবার চায়।