দেশে ধর্ষণসহ ছয় ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালীন মানুষের চলাচল সীমিত থাকলেও তাতে অপরাধ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং অগ্নিসংযোগ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, রাহাজানি এবং বিস্ফোরকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধের ঘটনাগুলো বেড়েছে। সামান্য হ্রাস পেয়েছে খুন, ডাকাতি এবং অস্ত্র আইন সংক্রান্ত অপরাধ। সামগ্রিকভাবে পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে এই নয় ধরনের অপরাধ বেড়েছে ৩ হাজার ৭৭টি (১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ)। অন্যদিকে কমেছে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা। সর্বশেষ অর্থবছরে পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ৯২ হাজার ১১৫টি মামলা কম নিষ্পত্তি হয়েছে। এই অর্থবছরে সব ধরনের বন্দির সংখ্যাও বেড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে উল্লিখিত অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে ২৫ হাজার ৭১১টি। যা ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছে ২৮ হাজার ৭৮৮টি। অন্যদিকে ফৌজদারি মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগ সূত্র বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে অনিষ্পন্ন ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৬ হাজার ৩১টি। এর মধ্যে ওই অর্থবছরে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬২ জন। এসব মামলায় শাস্তি পেয়েছেন ৬১ হাজার ৩২৯ জন। পূর্ববর্তী বছরে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ৬ লাখ ৬১ হাজার ৪৭৭টি। এসব মামলায় সাজা হয়েছিল ৫৬ হাজার ৪২১ জনের।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, ‘গত দুই বছর করোনার কারণে আদালত বন্ধ ছিল, অনেক সময় ভার্চুয়ালি হয়েছে। এতে মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে। আস্তে আস্তে এগুলোর সমাধান হচ্ছে। জমে থাকা মামলাগুলোর বিচারকাজ নতুন করে শুরু হয়েছে।’ করণীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মামলাজট কমিয়ে আনতে তদন্ত ও ট্রায়াল দুই পর্যায়ে কাজ করতে হবে। ট্রায়ালের পর্যায়ে সাক্ষী নিয়ে এসে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে। সাক্ষীর অভাবে মামলা ঝুলে থাকবে সেটা ঠিক নয়। এজন্য সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক ও তৎপর হতে হবে। তাহলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। আর তদন্তের পর্যায়ে মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। কোনো মামলা যেন অযথা পড়ে না থাকে।’
জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৪৫৮টি, যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৩ হাজার ৪৮৫টি। অর্থাৎ খুব সামান্য কমেছে। অপরদিকে ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা। পূর্ববর্তী বছরের থেকে ১ হাজার ৩৮০টি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গত অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২২২টিতে। বেড়েছে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও। গত অর্থবছরের তুলনায় তা বেড়ে ৩১ দশমিক ৯১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৬টিতে। অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে শেষ অর্থবছরে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১১২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে তা ১৭টি হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে নারী নির্যাতনের ঘটনাও। সর্বশেষ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ০৬ শতাংশ বেড়ে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৭টিতে।
তবে ডাকাতির সংখ্যা কমেছে বলে জানিয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র। পূর্ববর্তী বছরে এমন ৩৩৬টি ঘটনা ঘটলেও সর্বশেষ অর্থবছরে তা ১৫টি কমে ৩২১টিতে এসেছে। রাহাজানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। পূর্ববর্তী অর্থবছরের চেয়ে ১২৯টি বেড়ে সর্বশেষ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৮টি হয়েছে। কমেছে অস্ত্র আইনের অপরাধ। ১৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে তা সর্বশেষ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৪৭টিতে। সর্বশেষ অর্থবছরে ৪৪ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়ে বিস্ফোরকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২২টিতে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এভিডেন্স অ্যাক্ট পরিবর্তন ও নিু আদালত কেন্দ্রীক চক্রের তৎপরতা বন্ধ করা জরুরী। দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত তারিখ নেওয়া কিংবা দেরী করানো-এসবও মামলা জটের কারণ। সবমিলিয়ে পুরো বিচার পদ্ধতিরই একটা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এটাকে শুধু মলম দিয়ে ঢেকে রাখলে কাজ হবে না। এটাকে রিফর্ম করার চেষ্টা করতে হবে। প্রসিকিউটররা প্রকৃতঅর্থে কতোখানি কাজ করে, তারা কতোটুকোন যোগ্য, ভূক্তভোগীকে তাদের পক্ষ থেকে কতোখানি সাপোর্ট দেওয়া হয়- সেগুলোও দেখা প্রয়োজন। তাছাড়া পুলিশের যে চার্জশিট দিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে দেখা যায় অনেক ফল্ট থাকে। ফলে মামলাগুলো ভালোভাবে নিষ্পত্তি হওয়ারও সুযোগ থাকে না।’
দ্রুত বিচার আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র বলছে, আইন জারির পর থেকে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এ আইনে মামলা হয়েছে ২৯ হাজার ৩৬৭টি। এতে আসামি হয়েছেন এক লাখ ৬১ হাজার ২৭১ জন। সর্বশেষ ওই অর্থবছরে গ্রেফতার হয়েছেন ২ হাজার ৪১ জন আসামি। আইন জারির পর থেকে গ্রেফতার হয়েছেন ৫১ হাজার ৩৬০ জন আসামি। মোট মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২১ হাজার ১৪২টি। শাস্তি হয়েছে ৮ হাজার ৮২৭টি মামলায়। এতে আসামি ছিলেন ২১ হাজার ৭২৯ জন। মোট মামলার মধ্যে অভিযোগপত্র দায়ের হয়েছে ২৫ হাজার ৮০৯টির।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়েছে সব ধরনের বন্দির সংখ্যা। ৪ হাজার ৩ জন বেড়ে সর্বশেষ অর্থবছরে এই সংখ্যা হয়েছে ৭৫ হাজার ৬৮৫ জন। পূর্ববর্তী অর্থবছরের চেয়ে পুরুষ হাজতি ২ হাজার ৪৯৭ জন বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ২০০ জনে। পুরুষ কয়েদি ১ হাজার ৪৫৩ জন বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৪২৩ জন। বেড়েছে মহিলা হাজতি ও কয়েদির সংখ্যাও। মহিলা হাজতি ৩ জন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৭১ জন এবং মহিলা কয়েদি ১৫ জন বেড়ে হয়েছে ৫৬৩ জন। পূর্ববর্তী বছরে শিশু হাজতি একজনও ছিল না। সর্বশেষ অর্থবছরে তা পাঁচজন হয়েছে। তবে দুই অর্থবছরেই কোনো শিশু কয়েদি ও ডিটেইনি বন্দি ছিল না। রিলিজড প্রিজনার-আরপি (যেসব বিদেশি বন্দি মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় কারাগারে আটক) ৩০ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১২৩ জন।
সর্বশেষ অর্থবছরে বেড়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামির সংখ্যাও। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ১০৮ জন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩ জন। পূর্ববর্তী অর্থবছরে দুজন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও গত অর্থবছরে একজন বেড়ে তা তিনজন হয়েছে।
সীমান্ত হত্যার বিষয়ে জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দেশের সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষ হ্রাস পেয়েছে। কমেছে সাধারণ নাগরিকদের জীবনহানির ঘটনাও। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ছয়জন কমে এই সংখ্যা ২০ জন হয়েছে। তবে যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাদের সবাই ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ দ্বারা।