আজকের পত্রিকা

হত্যা

‘মাইরডা কইরা নিউ মার্কেটরে একটু দেহাইছি’

‘যা করা লাগে করবা, পরে যা করা লাগে আমরা করব। টিটি (টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ) ভাঙছি, নিউমার্কেট ভাঙছি, লাগলে সব ভাঙমু।’ সামান্য পরেই ভেসে আসলো আরেক ব্যক্তির কণ্ঠ। তাকে থামিয়ে আগের ব্যক্তি বলে চললেন, ‘তুমি বোঝো না কিছু। তুমি যে চিন্তা করো, এই চিন্তা করে ঢাকা কলেজে, ঢাহা শহরের রাজনীতি করোন যাইতো না। মাঝে মাঝে একটু দেহাই যে কিছু আমরা পারি। বোঝো নাই? মাইরডা কইরা নিউমার্কেটরে একটু দেহাইছি।’ 

গোয়েন্দাদের হাতে আসা নিউমার্কেটে হামলা সংশ্লিষ্ট এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের একটি অডিও রেকর্ডে শোনা গেছে দুই ব্যক্তির এমন কথোপকথন। সেখানে নিউমার্কেট এলাকায় হামলার পর উচ্ছ্বসিতভাবে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন তারা। কথোপকথনের রেকর্ডের কিছু অংশ অস্পষ্ট ছিল। কথোপকথনের দুজন সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একজন ঢাকা কলেজের আন্তর্জাতিক হলে এবং আরেকজন নর্থ হলে থাকেন। এরা নিউমার্কেট এলাকার সংঘর্ষে অন্যতম ইন্ধনদাতা বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। এই অডিও রেকর্ডকে নিউমার্কেট এলাকায় দুই হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ক্লু (সূত্র) হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা। 

ওই অডিও রেকর্ডের একটি অংশে ওই প্রথম ব্যক্তি আরও বলছিলেন-‘গিয়ে বলবা, জসীম ভাই পাডাইছে এই জায়গায়।’ ওই আলোচনায় উঠে আসে কিছুদিন আগে টিটি কলেজে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার আলোচনাও। সেখানে প্রথম ব্যক্তি বলেন, ‘এই বেডা, যহন ফিরোইজ্জা ফোন দিসে, মোতাহাইর‌্যা কইসে জসিম ভাই আহুক। আমি সঙ্গে সঙ্গে হেলমেট গেঞ্জি-মেঞ্জি পইরা জিনিসপত্র লইয়া বের হইছি।’

এদিকে রাজধানীর নিউমার্কেটে সংঘর্ষ ও দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, হেলমেটধারী ও অস্ত্রধারীদের বড় একটি অংশ শনাক্ত হয়েছে। তবে এখনো তাদের ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিলেও গ্রেফতার দেখানো হয়নি। কয়েকজনকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে গোয়েন্দাজালে আছেন অন্তত ১১ জন। এদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীও রয়েছেন।

তদন্তের এ পর্যায়ে এসে গোয়েন্দাদের হাতে ওই কথোপকথনের রেকর্ডটি আসে। সেখানে উল্লেখিত কয়েকজনের নাম যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি ছোট-বড় অন্তত ৯৫টি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সেগুলো থেকে উগ্র ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিদের ছবি কেটে আলাদা করে তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে নিউমার্কেটে দুই হত্যা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরে জড়িতদের গ্রেফতারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ঘটনায় চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা ও দোকানকর্মী মোহাম্মদ মুরসালিনের মৃত্যুর তদন্তে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করছেন তারা। বর্তমানে ২৪ জনের একটি নামের তালিকা রয়েছে। এদের বড় একটি অংশকে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কয়েকজনের হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া গেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলছেন না তারা। গোয়েন্দারা ঢাকা কলেজের মির্জা (গ্রামের বাড়ি মাগুরা) এবং ফিরোজ (বরিশাল) নামে দুজনকে খুঁজছেন। রোববার বিকালে ঢাকা কলেজ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জুয়েল নামের একজনকে নিয়ে যায় গোয়েন্দারা। পরে রোববার রাতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার কাছেও মির্জা ও ফিরোজের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে।

গত মঙ্গলবারের সংঘর্ষে দুজনকে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা দুটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, দুই হত্যার ঘটনার তদন্তে বেশ অগ্রগতি আছে। যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। খুব শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে জানাব।

নিউমার্কেটের সংঘর্ষের ঘটনার তদন্তে দুই হত্যা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দারা জানান, এই মুহূর্তে দুই হত্যার তদন্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী চার শীর্ষ নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদেও হত্যার বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। এই চার নেতার মধ্যে ঢাকা কলেজের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আসিফুজ্জামান রানার মুঠোফোনে নিহত কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদকে কুপিয়ে জখম করা ইমনের মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। রানাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইমনসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার অভিযানে অগ্রগতি আসে। তাদের খুব শিগগিরই গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলে জানায় গোয়েন্দা সূত্র। এছাড়া সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের ঘটনায় উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যাকে শনাক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাংবাদিক ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলাকারী যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই নিউমার্কেট এলাকার দোকান কর্মচারী অথবা হকার।

এদিকে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ ও দুজন নিহতের ঘটনায় রোববার ছয় অস্ত্রধারীর নাম-পরিচয় নিশ্চিতের কথা জানিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ। এই তালিকায় আরও নাম যুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন সোমবার বিকালে যুগান্তরকে জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা এবং নিজস্ব উপায়ে সংগৃহীত শতাধিক ফুটেজ তাদের কাছে রয়েছে। এসব বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে। খুব শিগগিরই গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, নিউমার্কেটে সহিংসতার ঘটনায় যারা চিহ্নিত হবে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সোমবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ঈদবস্ত্র বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আপনারা জানেন নিউমার্কেটে দুটি হত্যা কিংবা অ্যাক্সিডেন্ট যেটাই বলেন দুইটা ঘটেছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটেছে। মৃত্যু কারও জন্য কাম্য নয়, সে যে-ই হোক। আমরা দেখেছি, একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। এই সূত্রপাত থেকে বৃহদাকার একটা সংঘর্ষ হয়েছে। ছাত্র, ব্যবসায়ী, ছোট ছোট খুদে দোকানদার তারা এ ঘটনায় লিপ্ত হয়ে যায়। অন্যদের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও আহত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আপনারা দেখেছেন, আমাদের পুলিশকে টিয়ার গ্যাস এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এতে হতাহত হয়েছে যথেষ্ট।

মন্ত্রী বলেন, নিউমার্কেটের ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। মারপিটের মামলা ও ভাঙচুরের মামলা হয়েছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করা হয়েছে, সেটারও মামলা হয়েছে। মামলা মামলার গতিতে চলবে। যারা শনাক্ত হবে, ভিডিও ফুটেজ দ্বারা চিহ্নিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।