আজকের পত্রিকা

ব্যয় ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধি শুভংকরের ফাঁকি

ব্যয় ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধি শুভংকরের ফাঁকি

উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটাকে আপাতদৃষ্টিতে দূষণীয় মনে না হলেও প্রকারান্তরে খরচ বাড়ার যৌক্তিক অনেক বিষয় রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধাও বহাল থাকে। অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে প্রকল্পের এক খাতের টাকা কাটছাঁট করে অন্য খাতে জোগান দেওয়া হয়। এতে কাজের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন থেকে যায়। উপরন্তু যথাসময়ে প্রকল্পের সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় সরকার তথা দেশের জনসাধারণ।

২০২০-২১ অর্থবছরেই ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই মেয়াদ বেড়েছে ৩৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের। ৬ মাস থেকে সাড়ে ৩ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এছাড়া এর আগের অর্থবছরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২৮৪টি প্রকল্পে। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মেয়াদ বৃদ্ধির এসব তথ্য।

এ প্রসঙ্গে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লা যুগান্তরকে বলেন, ‘ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধি কথাটিই একটি ভুয়া কথা। কেননা মেয়াদ বাড়লে অবশ্যই ব্যয় বাড়বে। কন্টিনজেন্সি খাতসহ বিভিন্ন খাতে মোটা অঙ্কের টাকা ধরা থাকে। বর্ধিত মেয়াদে এগুলো খেয়ে ফেলা হয়। এছাড়া সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেটি থেকে সুফল না আসার যে আর্থিক ক্ষতি, সেটি তো মূল্যায়ন করা হয় না। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির একটি বিষয় থাকে। শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাব একনেকে অনুমোদনের জন্যই এমন কথা বলা হয়। যাতে কেউ আপত্তি না তোলে।’

প্রসঙ্গত, যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সম্পৃক্ত থাকেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও বেতনভাতার জন্য ব্যয় করতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। সাধারণত একটি প্রকল্পে রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের বাইরেও থাকে প্রায় ১১ ধরনের ভাতা। এগুলো হলো বাড়ি ভাড়া ভাতা, শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, টিফিন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, শিক্ষা ভাতা, মোবাইল/সেলফোন ভাতা, অন্যান্য ভাতা এবং ভ্রমণ ভাতা। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খরচের মধ্যে থাকে টেলিফোন বিল, গাড়ি পরিচালনা, ড্রাইভারের বেতন, গ্যাস ও জ্বালানি বিল, পেট্রোল-ওয়েল ও লুব্রিকেন্ট বিল এবং অফিস ব্যয়সহ নানামুখী ব্যয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে এ ধরনের ব্যয় চলমান থাকে। কিন্তু প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবের সময় সেটি আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফা কে. মুজেরী শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা প্রকল্প তৈরির সময়ই ফ্যাট বা চর্বি হিসাবে কিছু বাড়তি অর্থ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে এরকম ব্যয় বৃদ্ধি না করে মেয়াদ বাড়িয়ে সেখান থেকে খরচ করা হয়। সাধারণত ব্যয় ও মেয়াদ একসঙ্গে বাড়ালে সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। তবে শুধু মেয়াদ বাড়ালে সেটিকে বড় কোনো সমস্যা কিংবা ক্ষতির কারণ হিসাবে দেখা হয় না। স্বাভাবিক মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ খুবই ক্ষতিকর। কেননা একদিকে প্রকল্পটি থেকে যথাসময়ে সুবিধাবঞ্চিত হয় দেশ ও জাতি। অপরদিকে এটি প্রতারণার শামিল। কেননা এতে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকে। তবে করোনা মহামারির মতো বাস্তব কারণে কিছু প্রকল্পে এরকম ঘটলেও ব্যাপকভিত্তিক এই প্রবণতা রোধ করা উচিত।’

সূত্র জানায়, যেসব প্রকল্পে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতনভাতা দেওয়া হয়, সে ধরনের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে নির্ঘাত ব্যয় বাড়বে। এসব ক্ষেত্রে প্রকল্পের বাস্তব উন্নয়ন কাজ থেকে টাকা কাটছাঁট করে বেতনভাতা খাতে টাকা স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া মেয়াদ বাড়ার কারণে অনেক প্রকল্পের কেনাকাটা খাতে অবশ্যই ব্যয় বাড়বে। কেননা পণ্য যন্ত্রপাতির দাম ক্রমেই বাড়ে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৩৩৭টি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প রয়েছে ২৯টি এবং সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের ৪২টি প্রকল্প। এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ১৪টি, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ৩২টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের চারটি, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ১১টি এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ছয়টি প্রকল্প। আরও আছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের চারটি, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুটি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের একটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তিনটি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের চারটি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২৭টি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুটি, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি, বিদ্যুৎ বিভাগের ২৬টি প্রকল্প। এছাড়া জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের তিনটি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিনটি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চারটি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তিনটি, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের একটি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দুটি, পরিকল্পনা বিভাগের তিনটি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চারটি, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের ছয়টি, স্থানীয় সরকার বিভাগের ৩৩টিসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের মেয়দ বেড়েছে।

ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া শুধু মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে-জার্মানির বার্লিনে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পে মেয়াদ বেড়েছে সাড়ে ৩ বছর। এছাড়া তিন বছর মেয়াদ বেড়েছে ভুটানের থিম্পুতে বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন নির্মাণ প্রকল্প এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০০টি মিটার গেজ প্যাসেঞ্জার ক্যাজে সংগ্রহ প্রকল্পের। আড়াই বছর পর্যন্ত মেয়াদ বেড়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ২০তলাবিশিষ্ট নতুন অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্প, নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন, নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন প্রকল্পে। এছাড়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পেও বেড়েছে আড়াই বছর। দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদ বেড়েছে জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (ঢাকা জোন) প্রকল্প, নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা (বাগড়া)-কুনিয়া-মেদনী-রাজুরবাজার সংযোগ মহাসড়ক নির্মাণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন এবং সদর দপ্তর ও জেলা কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর শক্তিশালীকরণ প্রকল্প।