করোনার অভিঘাতের পরও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বেড়েছে। জুন, ২০২১-এর হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরের তুলনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এ বছর আমাদের মোট বিনিয়োগ নমিনাল জিডিপির প্রায় ২৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বিনিয়োগ অনুপাত ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, নেপালের ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ আর পাকিস্তানের মোট বিনিয়োগ জিডিপির মাত্র ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়েই আমাদের মোট বিনিয়োগ। বাংলাদেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৮০ শতাংশই বেসরকারি বা ব্যক্তিগত খাতে। কিন্তু দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজি সরবরাহের সীমিত সুযোগ-এই তিন সমস্যা ব্যক্তি খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত বুধবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১ : উদ্যোক্তা মতামত’ প্রকাশ করে উদ্বেগ জানানো হয়। ব্যবসা খাতে অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কথা উঠে এসেছে এই জরিপে।
ব্যবসায়ীদের মাঝে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে চালানো জরিপটির সময়কাল ছিল ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত। জরিপে ৭৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান কৃষি, সেবা ও উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১০ কোটি টাকারও বেশি। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ী আছেন ৩৯ জন, মাঝারি ১৭ জন, ছোট ব্যবসায়ী ১২ জন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন ৫ জন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৫ শতাংশ ব্যবসায়ীই মনে করেন, করোনার কারণে আমাদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগবে। তবে ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, এই ক্ষতি মাত্র এক বছরেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই অনুমানটি করা হয়েছে করোনার আর কোনো আঘাত আসবে না বিবেচনা করে।
ব্যবসা খাতের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা মোটা দাগে তিনটি সমস্যাকে দায়ী করেছেন : এক. দুর্নীতি; দুই. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা; তিন. পুঁজির জোগানের সীমাবদ্ধতা। এছাড়াও ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন সেগুলো হলো-করের নীতিতে জটিলতা, অদক্ষ জনবল, পর্যাপ্ত উদ্ভাবনের অভাব, বিভিন্ন অপরাধ ও চুরি, সরকারের অস্থিতিশীলতা, নৈতিকতা, মূল্যস্ফীতি ও শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা। এসব কারণে ব্যবসায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক ব্যবসায়ীর পক্ষেই বাজারে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে ব্যয় কমানোর কোনো বিকল্প নেই।
২২ শতাংশ বলেছে নতুন ক্রেতা খোঁজার কথা আর ১৯ শতাংশ ব্যবসা সম্প্রসারণ ও রপ্তানির নতুন বাজার খোঁজার ওপর গুরুত্ব দেয়। ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, করোনার কারণে তাদের বাধ্য হয়ে ব্যবসার খরচ কমাতে হচ্ছে, যে কারণে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে। ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ীই মনে করেন, আগামী ১০ বছরে দেশের ব্যবসাবাণিজ্যে সবচেয়ে বড় বাজার হবে ডিজিটাল সার্ভিস। এর সঙ্গে থাকবে ডেটা বিজনেস এবং প্লাস্টিক রিসাইক্লিং। অন্যদিকে আগামী ২ বছরে বৈশ্বিক পাঁচটি ঝুঁকি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করবে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি। বড় দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে বাংলাদেশের যে ঋণ রয়েছে, তা অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। কিছু শিল্পে বিপর্যয় আসবে। দ্বিতীয়ত, ভূ-রাজনৈতিক কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়, স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী আক্রমণের আশঙ্কা। তৃতীয় সমস্যা হলো পরিবেশগত ঝুঁকি।
এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা। চতুর্থ সমস্যাটি হলো সামাজিক সমস্যা। বিপুলসংখ্যক মানুষের বেকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাছাড়াও সামাজিক সমস্যার মধ্যে থাকবে বিভিন্ন রোগ ও নিরাপত্তার বিষয়টি। আগামী ২ বছরে পাঁচটি সমস্যার সর্বশেষ যে সমস্যাটিকে ব্যবসায়ীরা চিহ্নিত করেছেন তা হলো প্রযুক্তিগত ঝুঁকি। তাদের মতে, ডিজিটাল প্রযুক্তির কথা বলা হলেও ডিজিটাল কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে ১১০টি দেশের মধ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩।
তাছাড়া ডিজিটাল প্রযুক্তি বণ্টনেও বৈষম্য রয়েছে। সব ব্যবসায়ী এসব সুযোগ সমানভাবে পান না। প্রভাবশালীদের হাতেই তা জিম্মি। সব মিলিয়ে মতামত জরিপ থেকে কোনো আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, আগামী দিনগুলো তাদের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যবসায় সংক্রান্ত জরিপে ২০২০ সালে প্রধান সমস্যা হিসাবে উঠে এসেছিল প্রশাসনিক অদক্ষতা। দ্বিতীয় সমস্যা ছিল দুর্নীতি। এবারের জরিপে প্রশাসনিক অদক্ষতাকে টপকে এক নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে সর্বজন পরিচিত দুর্নীতি। ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ব্যবসায়ের পথে বড় বাধা। এখানে বলে রাখা ভালো, একটি হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা, আরেকটি হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দূর করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে সরকার ২০১৫ সাল থেকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) চালুর কথা চিন্তা করে। সেই লক্ষ্যে একটি আইন করা হয়, যা ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮ নামে পরিচিত।
এই সার্ভিসটি মনিটর করার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বিইজেডএ)। এই সার্ভিসের উদ্দেশ্য ছিল-এক. লাইসেন্স-পারমিট নিবন্ধনের সময়সীমা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা; দুই. লাইসেন্স-পারমিটের নিবন্ধন খরচ কমানো; তিন. দুর্নীতি কমিয়ে নিবন্ধনে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা; চার. সেবার গুণগতমান বৃদ্ধি করা। সে বিষয়ে একটি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এখন প্রয়োজন আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা দূর করা। ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্নীতি। এর লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন।
ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি, সমস্যা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যার সমাধানটাই সমস্যা। সমস্যার সমাধান বের করতে হলে প্রথমে সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত হয়ে গেলে তা আমলে নিতে হবে। তারপর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে এবং যথাসময়ে সমাধান করেও ফেলা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমস্যার সমাধান হয় না। কেননা আমাদের সমস্যা চিহ্নিত হয়; কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয় না। বরং সরকারের তরফ থেকে সমস্যা চিহ্নিতকারীকে তিরস্কার ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এমন বাস্তবতায় সমাধান পাওয়া যাবে কীভাবে? সাম্প্রতিক সময়ের একটি উদাহরণ দিয়েই আলোচনা শেষ করব।
পৃথিবীতে দুর্নীতিবিহীন কোনো দেশ নেই। এ বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে দুর্নীতির ওপর অনুসন্ধান ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। আমাদের দেশে সংস্থাটির শাখা রয়েছে, নাম ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ১৮০টি দেশে টিআই দুর্নীতি পরিমাপের যে পদ্ধতি অনুসরণ করে, তার নাম ‘করাপশান পারসেপশান ইনডেক্স’ (সিপিআই)। এই সূচকের সর্বোচ্চ মান ১০০। অর্থাৎ কোনো দেশের স্কোর যদি হয় ১০০, তাহলে বোঝা যাবে সেদেশে কোনো দুর্নীতি নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে কোনো দেশই ১০০ স্কোর করতে পারেনি। তবে ৮৮ স্কোর করে সবচেয়ে কম দুর্নীতির তালিকায় আছে ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্ক। অপরদিকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে আছে দক্ষিণ সুদান, যার স্কোর ১১। ১৮০টি দেশের গড় স্কোর যেখানে ৪৩, সেখানে আমাদের স্কোর গত ৪ বছর ধরে ২৬। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্কোর ৪০ আর পাকিস্তানের স্কোর ২৮। ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খারাপ থেকে ভালোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, যা আগের বছরে ছিল ১২তম। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, এক ধাপ ভালো করেছে বাংলাদেশ। অপরদিকে ভালো থেকে খারাপের তালিকায় বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর অবস্থান ছিল ১৪৬ নম্বরে, এবারে ১৪৭ নম্বরে।
যা হোক, সমস্যাটা চিহ্নিত হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল সমস্যাটি আমলে নিয়ে কাজ করা। তা না করে সরকারের উপর মহল থেকে বলা হলো, সংস্থাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। সরকারি দলকে হেয়প্রতিপন্ন করাই এর কাজ। অথচ এ সংস্থাটি বিএনপির সময়ে যখন বাংলাদেশকে ১ নম্বর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, তখন আজকের সরকারি দলই সেই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছিল। এ ধরনের দ্বিচারী নীতির ফলে এদেশে দুর্নীতির ডালপালা দিনকে দিন বেড়ে চলেছে এবং দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং সমস্যা যতই চিহ্নিত হোক, সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটলে কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না, যা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে কাম্য নয়।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়