আজকের পত্রিকা

বিপাকে ব্যবসায়ীরা

বিপাকে ব্যবসায়ীরা

ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রামের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা মারাত্মক বেকায়দায় পড়েছেন। রমজানে আমদানিনির্ভর ছোলা, মসুর ডাল, খেজুরসহ ভোগ্যপণ্যের দামের ওপর এই মূল্যবৃদ্ধির বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, এরই মধ্যে প্রতিটি আইটেমে এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে সর্বনিু ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত আমদানি মূল্যই বেড়েছে। এ ছাড়া নির্মাণসামগ্রী বিশেষ করে রডের দাম এখন সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি, করোনার ধকলে বাজারে নগদ ডলারের সংকট, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, আমদানি বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে ডলারের মূল্য বেড়েছে বলে মনে করছেন তারা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে তা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য অশুভ সংকেত। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারকে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

এদিকে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের কাছে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার থেকেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার যে অবমূল্যায়ন হয়েছে তা রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক আবুল বশর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপরই আমদানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। তাই ডলারের মূল্য বাড়লে পণ্যের মূল্য বা কস্টিংও বাড়ে। যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়ে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের মূল্য কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আসন্ন রমজানে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে। ডলারের মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ৮৬ দশমিক ২০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও সর্বশেষ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকে ৮৯ দশমিক ৩০ টাকা, আন্তঃব্যাংকিং লেনদেনে তা ৯০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ৯৪ টাকায় ঠেকেছে। যা উদ্বেগজনক।’

ইস্পাত শিল্পের তরুণ উদ্যোক্তা সারওয়ার আলম শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ডলারের দামের উল্লম্ফন দেখে তারা বেশ শঙ্কিত। গত দশ বছর ডলারের দাম ওঠানামায় একটা স্থিতিশীলতা থাকলেও এক মাসের ব্যবধানে যেভাবে বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। অকল্পনীয়। যেহেতু আমাদের বেশিরভাগ পণ্যই আমদানিনির্ভর সেহেতু ডলারের মূল্যের দিকটা বিবেচনায় রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল তথা স্ক্র্যাপের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে।

এক বছর আগেও যে রড ৫০-৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে তার দাম এখন লাখ টাকা ছুঁই ছুঁই। ভোক্তারা এই দামের ধকল সইতে পারছেন না। তাই আমদানি এলসি খুলতেও সাহস করছেন না শিল্পোদ্যাক্তারা।’ তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানিকারকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য অনেক সময় ডলারের মূল্য বাড়ানো হয়। কিন্তু রপ্তানির চেয়ে দেশে আমদানির পরিমাণ বেশি, সেটি মাথায় রাখতে হবে।’ গত ১৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে চট্টগ্রাম চেম্বার বলেছে, ‘মুদ্রাবাজারে টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

গত কয়েক মাসের ধারাবাহিকতায় ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত মূল্য ৮৬ দশমিক ০৫ টাকা হলেও ব্যাংকগুলোতে ৮৮ দশমিক ৫০ থেকে ৮৮ দশমিক ৫৫ টাকা পর্যন্ত দামে লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের দামের পার্থক্য ২ টাকার বেশি। ফলে আমদানিকারকদের বিপুল পরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। খোলাবাজারে ডলারের দাম ৯২ টাকা অতিক্রম করেছে। এমতাবস্থায়, আসন্ন রমজান সামনে রেখে ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ব্যয় বাড়ছে।

বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ।’ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য স্থিতিশীল থাকলেও শুধু ডলার মূল্যের পার্থক্যের কারণেও পণ্যভেদে প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা দাম বাড়ে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ডলারের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে উল্লেখিত খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সৌদি আরবে অবস্থানরত চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে প্রদত্ত চিঠির প্রসঙ্গে শুক্রবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকে পর্যাপ্ত ডলার রিজার্ভ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে এ সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা, বাজারে স্থিতিশীলতা আনয়ন, শিল্পের কাঁচামাল মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিকারকদের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধিসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামের যুগ্ম পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ডলারের দাম বৃদ্ধির বেশ কিছু কারণ বিদ্যমান আছে। করোনাকালে গত দুই বছরে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে যায়নি বা বিদেশ থেকে আসতে পারেনি। আসা-যাওয়া অব্যাহত থাকলে বাজারে নগদ ডলারের প্রবাহ বেশি থাকে। এজন্য সংকট সৃষ্টি হয় না। বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে গেছে। আবার করোনার সময়ে আমদানি কম হলেও এখন অনেক বেড়েছে। আমদানিকারকরা এলসি খুলেছেন প্রচুর। যার পেমেন্ট ডলারে দিতে হয়েছে বা হচ্ছে। এ কারণে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এই কারণেই ডলারের দাম সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।’

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বাজারে সংকট থাকলে সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিক্রি করে, আবার ডলারের দাম অস্বাভাবিক পড়তে থাকলে তা বাজার থেকে কিনে নেয়। এভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। এতে মুদ্রাস্ফীতি রোধ হয়। এ সংকটময় মুহূর্তেও নিশ্চয় বাংলাদেশ ব্যাংক সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেবে।’

আমদানিকারকদের অভিযোগ, চাহিদা অনুযায়ী বেসরকারি বা তফসিলি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে সংকটের কথা বলে নতুন এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন শাখা। আবার পূর্বের খোলা এলসির পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘোষিত রেটের চেয়ে চার টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এতে ব্যবসায়ীদের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পণ্য আমদানির বেড়েছে ৫২ শতাংশের ওপরে। একই সময়ে বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। ফলে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকের কাছে ডলার আসার উৎস তথা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ। গত বছরের আগস্ট থেকেই মূলত ডলারের মূল্য বাড়তে শুরু করে।