আজকের পত্রিকা

ছিনতাই

বিচারহীনতার কারণে বাড়ছে ছিনতাই

রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছিনতাই, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাত-এমনি হত্যারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। মধ্যরাত ও ভোরের দিকে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।

আর মধ্যবিত্ত ও নিু মধ্যবিত্তরা বেশি ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। নিুবিত্তরাও রেহাই পাচ্ছেন না। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ছিনতাইকারীদের বেপরোয়া করে তুলছে। তাদের দৌরাত্ম্যে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।

২০১৫ সালের পর থেকে ছিনতাইয়ের মামলা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। এটিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাফল্য বললেও সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার শিকার হয়ে অনেকে থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হন না। আবার অনেক সময় থানা মামলা না নিয়ে হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিয়ে থাকে। এ কারণেই মামলার সংখ্যা কমছে। 

ঢাকা শহরের ১৪ বছরের ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়-কিছু ঘটনায় বিচার হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ অপরাধী। ২০১৭ সালের পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। নয় মাসের হিসাব অনুযায়ী-রাজধানীতে ৮৮ ভাগ ছিনতাকারীর বিচার হয়নি। 

বিশ্লেষকরা জানান, ছিনতাইয়ের ঘটনাকে ‘হারানোর ঘটনা’ উল্লেখ করে জিডি এর অন্যতম কারণ। এতে অপরাধীরা সামান্য আইনি ব্যবস্থার মধ্যেও আসছে না। অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে মামলা করায় সাক্ষী পাওয়া যায় না।

এছাড়া মামলার তদন্তে প্রযুক্তির ব্যবহারেও রয়েছে ঘাটতি। এ অবস্থা থেকে বের হতে ছিনতাইয়ের অপরাধগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের কথা বলছেন তারা। পাশাপাশি ছিনতাইয়ের অপরাধকে ‘ছিনতাই’ নামে মামলা হওয়া উচিত।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, নানা ত্রুটির কারণে ছিনতাই মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে মামলার তদন্তে মূল সমস্যা হয়। তা না হলে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর খালাস পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অনেক সময় দেখা যায়-দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসেন না, আবার এলেও তারা সঠিক কথা বলেন না। জব্দ অর্থ ও দ্রব্য নিয়ে তারা ভুল তথ্য দেন। এ জন্য সাক্ষী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকতে হবে। 

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাই মামলায় তদন্তকারী সংস্থা, পাবলিক প্রসিকিউটরকে (পিপি) মূল ভূমিকা পালন করতে হয়। তারা গাফিলতি করলে মামলায় গাফিলতি থাকবে। এছাড়া আসামি ছাড়া পেয়ে যাবে। মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।

ছিনতাইয়ের মামলার ক্ষেত্রে বলা যায়-আইনের দুর্বলতা যতটা না, তার চেয়ে বেশি পদ্ধতিগত ও সদিচ্ছার অভাব। এছাড়া পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। এর বাইরে অপরাধগুলোর ‘ক্লারিফিকেশন’ ও ‘ওয়েল ডিফাইন’ করার ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি আছে।

এজন্য ছিনতাইয়ের অপরাধকে ডাকাতি বা দস্যুতা না বলে ‘ছিনতাই’ হিসাবেই উল্লেখ করা উচিত। ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। বিভিন্ন থানায় পুরনো মামলার তদন্তের বিষয়েও তিনি কথা বলেন।

রোববার শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে আমাদের বহুমুখী উদ্যোগ রয়েছে। ছিনতাই প্রতিরোধে ‘প্যানিক বাটন’ চালুর বিষয়টিও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।

এ অপরাধের মামলা গ্রহণে অনীহার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা বারবার বলছি-কোনো থানা মামলা না নিতে চাইলে আমাদের কাছে অভিযোগ করুন। কেউ এমন ঘটনার শিকার হলে এবং অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর কাওরান বাজারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান ছিনতাইয়ের শিকার হন। এরপর তেজগাঁও থানায় যান তিনি।

থানায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে যুগান্তরকে তিনি বলেন, ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার অভিযোগ জানাতে থানায় গেলে বলা হয়-‘ছিনতাই’ উল্লেখ করলে মামলা করতে হবে।

এ জন্য আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। আবার মোবাইল ফোন ফেরত পাওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর ‘হারিয়ে গেছে’ লিখলে জিডি হবে। এসব কথা শুনে হয়রানির ভয়ে ছিনতাইকে ‘হারিয়ে যাওয়া’ লিখে জিডি করে চলে এসেছি। 

গত বছরের ডিসেম্বরে সায়েন্স ল্যাবে মাদারীপুরের সোহেল মোল্লা ছিনতাইয়ের শিকার হন। সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, রাত ৯টার দিকে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ৪-৫ যুবক ঘিরে ধরে বলে-‘সব দিয়ে দে’।

শুরুতে দিতে না চাইলে গলায় ছুরি ধরে। এতে রক্ত বের হয়। এরপর মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও হাতঘড়ি দিলে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। ঝামেলার জন্য আর মামলা করা হয়নি।

১২ ফেব্রুয়ারি শেরেবাংলা নগরে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপিকা চৈতী সরওয়ারের মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়। এ ঘটনায় তিনি থানায় একটি হারানোর জিডি করেন। শনিবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, ফোনসেট এখনো ফিরে পাইনি। তদন্ত কর্মকর্তাকে ফোন দিলে ধরেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। ফলে মামলাগুলোর খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায় না। হারানোর জিডির তদন্তে অনেক সময় ফোন উদ্ধারে কিছু সাফল্য থাকলেও অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ফলে ছিনতাইকারী চক্রকে সমূলে উৎপাটন সম্ভব হচ্ছে না। ডিএমপি কমিশনারের ছিনতাই প্রতিরোধে কড়া নির্দেশনার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় তদন্তে অনীহা। 

২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন থানায় হওয়া মামলা থেকে শহরটির ছিনতাইয়ের ঘটনার একটি চিত্র পাওয়া যায়। এ ১৪ বছরে ছিনতাইয়ের (ডাকাতি ও দস্যুতা) ঘটনায় ৩ হাজার ৯৫৫টি মামলা হয়। তবে দণ্ডবিধিতে ছিনতাইয়ের বিষয়টি উল্লেখ নেই।

ফলে এ অপরাধকে ডাকাতি ও দস্যুতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। দণ্ডবিধিতে পাঁচজনের কম ব্যক্তির একসঙ্গে এ ধরনের অপরাধকে দস্যুতা এবং পাঁচ বা এর বেশি ব্যক্তির একসঙ্গে এ ধরনের অপরাধকে ডাকাতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

এজন্য পুলিশের খাতায় ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনাগুলোর আলাদা হিসাব রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী- ১৪ বছরে ঢাকায় ডাকাতির ঘটনায় ৬১৩টি এবং দস্যুতার ঘটনায় ৩ হাজার ৩৪২টি মামলা হয়েছে।

ছিনতাইয়ের মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়-২০০৮-২০০৯ সালের পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত মামলার সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। এরপর তা ক্রমশ কমতে থাকে। ২০০৮ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকায় ৭৫৫টি মামলা হয়। ২০০৯ সালে ৫৪০টি, ২০১০ সালে ২৬৭টি, ২০১১ সালে ৩৩৭টি, ২০১২ সালে ২৮৮টি, ২০১৩ সালে ২৮৮টি, ২০১৪ সালে ৩১২টি এবং ২০১৫ সালে ২৫০টি মামলা হয়। ২০১৫ সালের পর আবার বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ সময় থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছিনতাই মামলার সংখ্যা আর ২০০-এর ঘরই ছোঁয়নি। ২০১৬ সালে ১৫৪টি, ২০১৭ সালে ১২০টি, ২০১৮ সালে ১০০টি, ২০১৯ সালে ১৭৬টি, ২০২০ সালে ১৯৭টি এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ১৬৮টি মামলা হয়। এছাড়া ২০১৮ সালে দস্যুতার মামলাও রেকর্ড সংখ্যক কমে মাত্র ৮৩টিতে দাঁড়ায়। যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, ১৫-২০ বছর আগের তুলনায় ছিনতাই অনেকটা কমেছে। তবে এখনো যেটা হচ্ছে সেটা কম নয়। এরমধ্যে সাইবার ক্রাইমের মতো অন্য সব অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোকে ছোটখাটো অপরাধ মনে করছে। এ কারণে তারা এ অপরাধকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। এছাড়া বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির মতো দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে মানুষকে পুলিশ বোঝায়- ঝামেলার মধ্যে যাবেন কিনা?

ফলে মানুষ থানায় যাচ্ছে না। গত দুই বছরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ২৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা বিশ্লেষণ করেছে যুগান্তর। ঘটনাগুলোয় গ্রেফতারদের বড় একটি অংশ ছিল মাদকাসক্ত এবং পেশাদার। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, চাকরি হারানো ব্যক্তি, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শখের বসে অপরাধে জড়ানো ব্যক্তিরা ছিলেন। ছিলেন নারী ছিনতাইকারীও। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে অনেকে ছিনতাই করতেন। ছিনতাইয়ে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপরই রয়েছে প্রাইভেটকারের ব্যবহার।

এছাড়া এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপ পরিবহণের ব্যবহার ছাড়াই সম্পদ লুটে নিয়ে সটকে পড়ে। দুইভাবে ছিনতাইয়ের টার্গেট করা হয়। একটি হলো-টাকা লেনদেন হয় এমন এলাকাগুলোয় নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে সুবিধাজনক স্থানে গতিরোধ করে ছিনতাই। অন্যটি হলো-ছিনতাইকারীদের টার্গেট এলাকা দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তির সর্বস্ব লুটে নেওয়া। ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, ২৩টি ঘটনার মধ্যে ভুক্তভোগীদের ২১ জনের ব্যক্তিগত পরিবহণ নেই। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত, নিু মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্ত। ২৩টি ঘটনার ভোরে ১৫টি, মধ্যরাতে চারটি, সন্ধ্যায় তিনটি এবং দিনের বেলায় একটি ঘটে।