আজকের পত্রিকা

বাসা

বর্ষণমুখর রাতে শেখ হাসিনা ওঠেন ফুপুর বাসায়

চরম প্রতিকূল অবস্থায় স্বজনহারা শেখ হাসিনা ফেরেন দেশের মাটিতে। সেটা ছিল ১৯৭৫-এর পাঁচ বছর নয় মাস পরের ঘটনা। দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৯৮১ সাল। সেদিন ঢাকায় ছিল তুমুল বৃষ্টি, বইছিল ঝড়ো হাওয়াও।

মানিক মিয়া এভিনিউয়ে গণসংবর্ধনা শেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা যখন লালমাটিয়ায় ফুপুর আশ্রয়ে এলেন, তখন তাদের বুকে বইছিল অদৃশ্য এক ঝড়।

সেই ঝড় অশ্রুধারা হয়ে বেরিয়ে এলো ফুপু-ভাতিজির চোখ বেয়ে। প্রথম এসে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা হোসেন লিলির বাসায়। ছোট্ট মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে নিয়ে ৫/১২, ডি ব্লক, লালমাটিয়ায় ছোট ফুপু লিলির ভাড়া বাসায় উঠলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এই বাড়িতেই বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন তিনি।

‘মাঝে মাঝে মনে হয় এ বাড়িতে হেঁটে বেড়াতেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিশ্চয় এই বারান্দায় মন খারাপ করে বসে থাকতেন তিনি। কখনো কখনো মনে হয়, তিনি কি আমাদের এই রুমে ঘুমাতেন। বাবা-মা ও ছোট ভাইদের চিরদিনের জন্য হারানোর যন্ত্রণায় তার চোখে কি ঘুম আসত? এখনো কি তার মনে আছে সেদিনের কথা? তিনি কি কখনো এ বাড়িতে আসার কথা ভাবেন? আমার তো মনে হয় তিনি হঠাৎ একদিন আসবেন, আমি দেখব তিনি বসে সবার সঙ্গে কথা বলছেন, চা খাচ্ছেন। ঘরময় ঘুরে ঘুরে এই কথাগুলো বলছিলেন ওই বাড়ির মালিক প্রয়াত নূর আহমদের পুত্রবধূ তাইয়্যেবা আলম লাভলী। স্বামী শওকত আলমের সঙ্গে তিনি এখন এই বাসায় বসবাস করছেন। 

সোমবার তাইয়্যেবা আলম লাভলী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি শাশুড়ির কাছ থেকে শুনেছি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কথা। আমরা এখন ৫ তলা ভবনের এই যে তিনতলায় রয়েছি, ঠিক এই বাসাতেই ফুপুর সঙ্গে থাকতেন তিনি।’ লাভলী জানালেন, শুধু বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন ও মেয়েকে বাসা ভাড়া দেওয়ার কারণে এরশাদ সরকার তার শ্বশুরকে ‘ডিমোশন’ দিয়ে ঢাকা থেকে রাজশাহী পাঠিয়েছিলেন। তার শ্বশুর প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নূর আহমদ ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। 

বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা হোসেন লিলির স্বামী প্রয়াত সৈয়দ হোসেন ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। ’৭৫-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে যখন তাদের কেউ বাসা ভাড়া দিচ্ছিলেন না তখন নূর আহমদ বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের পরিবারকে এই বাড়িতে আনেন। এই সৈয়দ হোসেনের মেয়ে রোজীকে বিয়ে করেন বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামাল। ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রোজীও। তাই তৎকালীন সামরিক সরকার সৈয়দ হোসেনকে চোখে চোখে রাখছিল। বাড়ির মালিক প্রয়াত নূর আহমদের ছেলে শওকত আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘ভয়-ডর উপেক্ষা করে এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমার আব্বা এই বাড়ির তিনতলা বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনকে ভাড়া দিয়েছিলেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্ডিয়া থেকে ফিরে উঠেছিলেন এই বাসায়। তিনি এখানে কিছুদিন কাটিয়েছেন।’ স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম একদিন সকালে আব্বা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে বলছেন, আমি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। এখন ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। আপনি এখানে থাকলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ বাড়িতে ভিড় করবেন। এতে আমার চাকরির সমস্যা হতে পারে। তাই আপনি কিছু মনে না করলে এখানে না থেকে অন্য বাসায় থাকলে ভালো হয়। তারপর জি চাচা বলে তিনি (শেখ হাসিনা) আমার আব্বাকে আশ্বস্ত করে অন্য বাসায় চলে যান।’

জিয়াউর রহমান ওই বছরের ৩০ মে চট্টগ্রামে নিহত হন। শেখ হাসিনা এই বাড়ি ছেড়ে পাশেই ২/১৬ বি ব্লকে, লালমাটিয়ায় আরেক ফুপু আসিয়া বেগমের ভাড়া বাসায় ওঠেন। তবে ছোট ফুপু খাদিজা হোসেন লিলি ৫/১২, ডি ব্লক, লালমাটিয়ার ওই বাসায় আরও কিছুদিন ছিলেন। একপর্যায়ে শেখ হাসিনাকে ছাড়তে হলো ছোট ফুপুর বাসা। নতুন যে বাড়িতে তিনি উঠলেন, সেখানেও ছিলেন তিনতলায়। আরেক ফুপু আসিয়া বেগম ছেলে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ মারুফ এবং নাতি তাপসকে নিয়ে থাকতেন এই তিনতলায়। বাড়িটি ভেঙে পরে বহুতল ভবন করা হয়েছে। তখন বাড়ির মালিক খলিলুর রহমান খন্দকার দোতলায় বসবাস করতেন।

খলিলুর রহমান খন্দকার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ’৭৬ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ইলিয়াস চৌধুরী একদিন এসে তাকে এই বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাদের কেউই বাসা ভাড়া দিচ্ছে না জানিয়ে অনুরোধ করলে তার খুব খারাপ লাগে এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাসা ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানান। পরে বঙ্গবন্ধুর বোন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে ওঠেন। শেখ হাসিনাও এই বাসায় ছিলেন। তিনি জানান, ’৭৫-পরবর্তী ওই দুঃসময়ে তাদের বাসা ভাড়া দিতে কষ্টই হতো। মাঝে মাঝে মতিঝিলে বাংলার বাণী পত্রিকা অফিসে গিয়ে ভাড়া নিয়ে আসতেন খলিলুর রহমান খন্দকার। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির পান্ডারা রোডের বাসা ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। যোগ দেন আণবিক শক্তি কমিশনে। ওই বছরের ডিসেম্বরে স্বামীর মহাখালীর সরকারি বাসায় গিয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা।