ধান-চালের বাজারে করপোরেট হাউজ ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীর চোখ পড়েছে। আগে মিলাররা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন মূলত তারাই কলকাঠি নাড়ছে।
অতিমুনাফার লোভে মৌসুমি ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে গোডাউনে মজুত করেছেন।
এই ধান সিন্ডিকেট করে মিলারদের কাছে বিক্রি করছেন বাড়তি দরে। পাশাপাশি করপোরেট হাউজগুলো বাড়তি দামে প্যাকেটজাত চাল বিক্রির উদ্দেশ্যে ধান মজুত করছেন। এ কারণে মিল পর্যায়ে চাল উৎপাদনে দাম বেড়ে যাচ্ছে। খোদ খাদ্যমন্ত্রী এই দাম বাড়ার নেপথ্যে দেশের ছয়টি শীর্ষ করপোরেট গ্রুপকে দায়ী করেছেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভরা বোরো মৌসুমেও মাসের ব্যবধানে মিল থেকে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চাল ৪০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভার পাইকারি বাজারে গিয়ে পড়েছে। ফলে খুচরা বাজারে ভোক্তারা বাড়তি দরে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেট ভাঙতে যেভাবে মিল পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে চালের দাম কমাতে অভিযান পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য অধিদপ্তর এবং বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। তদারকির আওতায় এনে চালের দাম কত টাকায় কেনা এবং কত টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে, সেই তালিকা নেওয়া হচ্ছে। অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ফলে বাজারে একদিনের ব্যবধানে প্রতি মন ধান ১০০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বুধবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, ছয়টি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে চাল কিনে সেটা প্যাকেট করে বিক্রি করায় বাজারে প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, এসিআই, আকিজ, বসুন্ধরা, প্রাণ, সিটি ও স্কয়ার গ্রুপ দেশের বিভিন্ন মিল থেকে বেশি দামে চাল কিনে আরও বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে অন্য ব্যবসায়ীরা হঠাৎ ধান-চাল মজুতের ব্যবসায় নেমেছেন। একই সঙ্গে সাধারণ ভোক্তাদের অনেকে চালের বাজার অস্থির দেখে কয়েক মাসের চাল একসঙ্গে কিনে রাখছেন। এভাবে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধভাবে মজুত ঠেকাতে গত সোমবার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উল্লিখিত ছয়টি প্রতিষ্ঠানের চাল মজুতের বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিভিন্ন টিম মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর কাওরান বাজারসহ বেশকিছু বাজারে চালের আড়তে পরিদর্শন এবং অভিযান পরিচালনা করেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও অভিযান চালানো হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, দেশের বাজার থেকে চাল কিনে প্যাকেটজাত করে তা আবার বিক্রি করা যাবে না। তবে আমদানি করে প্যাকেট চাল বিক্রিতে বাধা নেই। এজন্য একটি সার্কুলার জারির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। বড় মিল মালিকদের দিকেও নজর রাখা হচ্ছে জানিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, যারা একেবারেই ধান ব্যবসায়ী নন, তারাও মজুত করছে, ইটভাটাওয়ালাও মজুত করছে। এটাও আমরা খুঁজে পেয়েছি। এমনকি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকও চাল কিনে মজুত করছেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ছয়টি প্রতিষ্ঠান ব্যাগিং করে একই চাল যেটা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পড়ছে, সেটা প্যাকেটজাত করে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করছে। একই সঙ্গে আগাম টাকা ও প্যাকেট মিলারদের দিয়ে আসছে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে। আমরা সেগুলোও বন্ধ করেছি। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সেটা আমরা চিন্তা করছি যে, এই সার্কুলার জারি করা যায় কি না, যারা প্যাকেট করে চাল বিক্রি করবে তারা দেশের বাজার থেকে কিনতে পারবে না। তারা ৬৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আমদানি করে প্যাকেট করবে। এটা আলোচনা চলছে। কালও আমাদের মিটিং হয়েছে।
সাধারণ ভোক্তাদের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অনেকে এক মাসের চাল একসঙ্গে না কিনে তিন মাসেরটা কিনছে, এটি দাম বাড়ার কারণ। আমি ভোক্তাদের বলতে চাই, একসঙ্গে চার থেকে পাঁচ মাসের চাল কিনে বাজার অস্থিতিশীল করবেন না। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মজুতদারদের মধ্যে দল-নির্দল কোনো কিছুই দেখার বিষয় নেই। কারণ মজুতদাররাই একটি ভিন্ন দল। ১৯৭৪-এর স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে মামলা করতে নির্দেশ দিয়েছি। ডিসি সাহেবরা এ বিষয়ে একটু ভয় পাচ্ছেন। আমি বলেছি, এই আইনেই মামলা করতে। এ সময় মন্ত্রী বলেন, প্রয়োজন হলে সিন্ডিকেটকারীদের উচিত শিক্ষা দিতে ট্যাক্স কমিয়ে চাল আমদানি করা হবে। তাহলে শিক্ষা পাবে।
সিন্ডিকেট সরকারের চেয়ে ক্ষমতাবান নয় জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের আগমুহূর্তে কেউ কেউ একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। আমরা সচেতন আছি। আশা করি সমস্যা হবে না।
সরকার করপোরেট ফাঁদে পড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না কোনো ফাঁদে পড়েনি। ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করছিল, আমরা রিকভার করছি। প্যাকেট করার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, নিজস্ব মিল থাকলেও সে তার লাইসেন্সে যে মজুতের বিধান আছে এর বাইরে মজুত করতে পারবে না। মিলের যে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতা, এর তিনগুণ সে মজুত করতে পারবে। এর বাইরে থাকলে সেটা অবৈধ মজুত। মন্ত্রী জানান, বিভিন্ন জেলায় অভিযান চলছে। মন্ত্রী বলেন, কোনো শিল্পগ্রুপ মিল ভাড়া নিয়ে নিজেদের নামে চাল বাজারে ছাড়তে পারবে না। যে মিলের চাল, সেই মিলের নামেই চাল বাজারে ছাড়তে হবে। কোনো কোনো মিলে অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে বস্তা পাওয়া গেছে। সেসব কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, মিল মালিক এবং চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করছি। সেখানেও বলা হচ্ছে এবং মন্ত্রণালয় থেকে আমরা চিঠিও দিয়েছি।
এদিকে কথা হয় নওগাঁ জেলার কৃষক মো. শাহ আলী আকবর মিয়ার সঙ্গে। তিনি বুধবার মোবাইল ফোনে আক্ষেপ করে যুগান্তরকে বলেন, ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে বড় কিছু কোম্পানি ও কিছু মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী আমাদের কাছ থেকে ৮০০-৯০০ টাকায় প্রতি মন ধান কিনে নিয়ে গেছে। এতে আমাদের কিছু টাকা লোকসান হয়েছে। তারপরও বিক্রি করতে হয়েছে। আমাদের কাছে কম দামে কিনে তারা ধান মজুত করেছে। বিক্রি করছে বাড়তি দরে। তিনি জানান, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত নওগাঁর বাজারে ১৪০০ টাকা মন দরে ধান বিক্রি হয়েছে। তবে সরকারের তদারকির ঘোষণার পর বুধবার মনপ্রতি ১০০ টাকা কমে ১৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তারপরও ৪০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছে।
মিল পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, সেখানে প্রতি বস্তা মিনিকেট ৩২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক মাস আগে ২৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি বস্তা বিআর ২৮ চাল বিক্রি হয়েছে ২৩৫০ টাকায়, যা আগে ২১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। স্বর্ণা চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২১৫০ টাকা, যা আগে ১৯৫০ টাকা ছিল।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কায় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এরপর আবার বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি সরাসরি কৃষক পর্যায়ে ধান ক্রয় করে মজুত করছে। তাই কোম্পানির সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ও মাঝারি মিলাররা পাল্লা দিতে পারছে না। তারা ধান কম দামে কিনে বেশি দরে বিক্রি করছে। ফলে চাল উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আর ধান সংগ্রহ করতে না পারায় বাজারের চাহিদামতো চাল সরবরাহ করতে পারছি না। সরকারের উচিত এখনই এসব বড় প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেওয়া। না হলে সামনে চালের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ করে এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ২(ঙ) ধারায় মজুতদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোন আইন দ্বারা কোন ব্যক্তি মজুত বা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুত বা সংরক্ষণ করা। আইনের ২৫(১) ধারার বিধানে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কেউ মজুতদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী হলে তার আজীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। যদি প্রমাণ হয়-মজুতদার কোনো লাভের জন্য পণ্য মজুত করেনি, তাহলে তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় খাদ্য বিভাগের গেজেটে বলা হয়েছে, অটোমেটিক রাইস মিল, মেজর রাইস মিল ও হাসকিং মিল ধান ১৫ দিনের ছাঁটাইয়ের পাঁচগুণ ৩০ দিনের জন্য মজুত রাখতে পারবে। পাশাপাশি চালের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-অটোমেটিক রাইস মিল, মেজর রাইস মিল ১৫ দিনের ছাঁটাই ক্ষমতার দুইগুণ ১৫ দিন মজুত রাখতে পারবে। আর হাসকিং মিল সর্বোচ্চ ১০০ টন চাল ১৫ দিনের জন্য মজুত রাখতে পারবে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বোরো ধান উৎপাদন মৌসুমে চালের বাজার অস্থির। কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল না। কেন এমন পরিস্থিতি হয়েছে, তা বের করতে হবে। কেউ যদি ধান-চাল মজুত করে, তাহলে তা বাজারে ছেড়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের যেসব বিদ্যমান আইন আছে, এর যথাযথ প্রয়োগের সঙ্গে মজুতদারি আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। অসাধুদের ধরে শুধু অল্প পরিমাণে জরিমানা করলে হবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজধানীর বাবুবাজার, বাদামতলী ও কাওরান বাজারের চালের পাইকারি আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার পাইকারি পর্যায়ে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৩৩০০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ২৯০০ টাকা। বিআর ২৮ চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৪০০ টাকা, যা আগে ছিল ২২০০ টাকা। মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চালের বস্তা বিক্রি হয়েছে ২৩০০ টাকা, যা আগে ২০৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল বিক্রেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মিল পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। আমরা চাহিদামতো চাল পাচ্ছি না। অগ্রিম টাকা দিলেও চাল মিলছে না। মিল পর্যায় থেকে বস্তায় ৪০০ টাকা বেশি দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বড় করপোরেট ব্যবসায়ী ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে।
রাজধানীর মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক ও খুচরা চাল বিক্রেতা মো. দিদার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রতি কেজি মিনিকেট ৬৬-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ৬০-৬৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নাজিরশাইল চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা। এক মাস আগে ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পাশাপাশি প্রতি কেজি বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৭ টাকা, যা আগে ৫০ টাকা ছিল। এছাড়া মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা, যা এক মাস আগে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।