আজকের পত্রিকা

নিয়োগের আগে নাম প্রকাশের পরামর্শ

নিয়োগের আগে নাম প্রকাশের পরামর্শ

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে তাদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত।

তাহলে ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কিনা, তারা নিরপেক্ষ কিনা-তা যাচাই করা যাবে।

যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই এবং যারা আইন প্রয়োগের সক্ষমতা রাখেন-তাদের নিয়োগ দিতে হবে।

বুধবার ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ ও ‘সিটিজেনস ফর গুড গভর্ন্যান্স’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

তারা নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপরও জোর দেন। বক্তারা তড়িঘড়ি করে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন পাশ করতে যাওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন।

‘প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন : জন-আকাঙ্ক্ষা ও করণীয়’ শীর্ষক এ অনলাইন আলোচনায় বক্তব্য রাখেন সাবেক সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ পরিচালক আবদুল আলিম ও সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। আর সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক রওনক জাহান।

নিয়োগের আগে সম্ভাব্য সিইসি ও কমিশনারের নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত মন্তব্য করে সাবেক সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, কমিশনার হিসাবে যাদের নাম সুপারিশ করা হবে তাদের নাম প্রকাশ করা উচিত। এটা করলে পাবলিক তাদের দেখতে পারবেন, মতামত জানাতে পারবেন।

এ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতাও আসবে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের লিখিত-অলিখিত অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আছে, তাদের বিবেচনাতেই নেওয়া ঠিক হবে না। এখানে তিন-চারটি পদ। এর জন্য দেশে ভালো মানুষের অভাব হবে না। একটি ভালো কমিশন করতে হলে কোনো দাগ লাগা লোক আনা যাবে না। তিনি আরও বলেন, ইসি এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে, যার পুরো জীবনে কোনো দাগ নেই। অভিযোগ এসেছিল, আবার ছাড়াও পেয়েছেন, এমন লোক ইসিতে আনতে হবে কেন? নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের নিরপেক্ষতা দেখতে হবে।

নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রসঙ্গে সাবেক এ সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন দুই থেকে আড়াই পৃষ্ঠার বেশি হওয়ার কথা নয়। সব কথা কেন আইনে বলতে হবে। বিধিমালায় বলা যেতে পারে। আইন বড় হলে ভালো হবে-এমন কথা নেই।

আর সময় দিয়ে আইন প্রণয়ন করতে হবে। এখন ৩ দিনের একটি আইন হচ্ছে। সংসদে আইন নিয়ে আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল, কিন্তু তা হয়নি।

তিনি বলেন, আইনের খসড়ায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সার্চ কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে এবং আইনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারের অধীন এবং রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত। এছাড়া বিদায়ি সিইসিকেও সার্চ কমিটিতে রাখা যায়। কারণ, তার আর ইসিতে ফিরে আসার সুযোগ নেই। তার পাঁচ বছরের কাজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাও থাকে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসি গঠনে প্রথমেই দেখতে হবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের নিরপেক্ষতা দৃশ্যমান কিনা। আর দেখতে হবে, তাদের আইন প্রয়োগের সক্ষমতা আছে কিনা? জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় ছয় লাখ লোক নিয়োগ দিতে হয়। তাদের পরিচালনা করার মতো যোগ্যতা থাকতে হবে। নির্বাচনে ১০০ মানুষ মারা গেলেন, আর বলা হলো আমার কিছু করার নেই! তাহলে তো কোনো লাভ নেই।

দায়িত্ব ইসিকে নিতে হবে। ইসি গঠনে সংসদ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছু করতে পারেন না। ফলে সার্চ কমিটির বাছাই করা নাম প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেই। যদি সার্চ কমিটির বাছাই করা নাম সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠানো হয়, সেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা ও অন্য বড় দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এতে আরও লাভ আছে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রীর মত সংসদীয় কমিটিতেই চলে আসবে। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে সার্চ কমিটির বাছাই করা নামগুলো বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়বে। মানুষ ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে পারবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির সুযোগ হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনার পদে যাদের নাম আসবে সেগুলো প্রকাশ করতে হবে। আর তা প্রকাশ করা হলে ওই ব্যক্তিদের সততা, সাহসিকতা, স্বচ্ছতা ও দলনিরপেক্ষতা আছে কনা-তা বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে সার্চ কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনে যেসব শর্ত ছিল, আর এবার যে প্রস্তাবিত আইনে যা বলা হয়েছে তা প্রায় একই ধরনের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে যা ছিল খসড়া আইনে তাও বাদ দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে কোনো আলোচনা ছাড়াই সরকার আইন করতে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার গঠনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা আইনমন্ত্রীর কাছে একটি খসড়া আইন প্রস্তাব করেছিলাম। ওই সময় আইনমন্ত্রী আমাদের বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আইন করার যথেষ্ট সময় নেই। হঠাৎ করেই ১৭ জানুয়ারি কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে খসড়া আইন তোলা হলো; যাতে বর্তমান সিইসি কেএম নূরুল হুদার মতো অনুগত ও সুবিধাভোগী কমিশনার নিয়োগ দেওয়া যায়। তিনি বলেন, খসড়া আইনে সাদামাটা যোগ্যতা-অযোগ্যতার শর্ত যুক্ত করে নতুন মোড়কে পুরোনো রীতি রাখা হয়েছে। এতে যোগ্য নির্বাচন কমিশনার অনুসন্ধানের কোনো সুযোগ নেই। লিখিত বক্তব্যে তিনি ছয়টি সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-অনুসন্ধান কমিটিতে সরকারি, প্রধান বিরোধী ও তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের একজন করে সংসদ সদস্য রাখা, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা নামের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর সময় হাতে রেখে প্রক্রিয়া শুরু করা।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, শুধু নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের সময় সরকারের ধরনটা কেমন হয়, এর ওপর সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে। যত ভালো আইনই হোক না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের মৌলিক পরিবর্তন লাগবেই। তিনি বলেন-ডিসি, ওসি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কাদের করা হয় তা সবাই জানে। গত এক যুগে প্রশাসনে যে সেটআপ তৈরি হয়েছে সেটি পরিবর্তন করা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলোতে কীভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়-সেই উদাহরণ টেনে আবদুল আলিম, বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি নিয়োগ করা হয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছাই করা নাম প্রকাশ করতে হবে; যাতে মানুষ মতামত দিতে পারে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক রওনক জাহান বলেন, ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বচ্ছতা। এটা না থাকলে রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য আসবে না।