রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতা তেমন কোনো কাজে আসছে না। ওষুধে তেমন ফল মিলছে না। কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুমে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। আর বছরজুড়ে এডিস মশার কামড়ে নাজেহাল হচ্ছে মানুষ। বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা ব্যয়ের পাশাপাশি অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ।
এদিকে মশা নিয়ে রোববার উচ্চ আদালতেও আলোচনা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মশা নিয়ন্ত্রণে জরিপ পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জরিপের পাশাপাশি এ বিষয়ে আগামী ৮ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বেসামরিক বিমান চলাচল (বেবিচক) কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
চলতি অর্থবছরের মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ১১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির বরাদ্দ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির জন্য ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বিপুল অঙ্কের টাকা মশক নিয়ন্ত্রণ বরাদ্দ, যা মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এর কোনো সুফল মিলছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে পরিচালনা করতে হবে। তবেই সাফল্য আসবে। কিন্তু রাজধানীতে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সেভাবে পরিচালনা হচ্ছে না। শীত মৌসুমে নর্দমা, জলাশয় ও আবর্জনা পরিষ্কার রাখলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়বে না। একইভাবে ডোবা, নালাসহ শহরে পানি জমবে না-বর্ষার শুরুর আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। তবেই এডিসের প্রজনন মৌসুমে উপদ্রব থেকে রক্ষা মিলবে। এ কাজগুলো করতে হলে বছরজুড়ে নগরবাসীকে তৎপরতা চালাতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্সকালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেন রয়েছে। যেগুলোতে দুই সিটি মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। পাশাপাশি প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী, পলিথিন, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় ওই ড্রেনগুলো ভরাট থাকে। দুই ভবনের মাঝের জায়গাগুলো আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। জমাটবদ্ধ পানিতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপে বংশ বিস্তার করছে। এসব স্থানে মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। এছাড়াও জলাশয়, খাল, নর্দমা ও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্য সামগ্রী ও ডাবের খোসার পানিতে ভয়াবহরূপে মশার বংশ বিস্তার ঘটছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর এডিস মশার লার্ভার বিষয়ে এক জরিপ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকার ৪ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডে ২৫ মার্চ থেকে শুরু জরিপের নবম দিনে এমন চিত্র মিলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম এ তথ্য দেন। ওই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তা হাউজ ইনডেক্স। আমরা মশার ঘনত্বও হিসাব করব। যদি মশার লার্ভার ঘনত্বের ইনডেক্স বেশি পাওয়া যায়, সেটা চিন্তার বিষয়। তার সঙ্গে হাউজ ইনডেক্সটা বেশি থাকলে সেটাও চিন্তার বিষয়। কারণ করোনাভাইরাসের সময় নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২৫ মার্চ থেকে দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডে জরিপ চলছে। ২১ জন কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গড়া দল এসব বাড়ি পরিদর্শন করছেন। এর আওতায় মোট ৩ হাজার ১৫০টি বাড়িতে জরিপ চালানো হবে। শনিবার পর্যন্ত জরিপ করা হয়েছে ২৫২০টি বাড়ি। জরিপে ১১৪টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, যা মোট বাড়ির ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মশা নিয়ে রোববার উচ্চ আদালতেও আলোচনা হয়েছে। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ বলেন, চলতি বছরের গত ২০ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশা নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এছাড়া বেবিচক চেয়ারম্যানকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেছিলেন। সেই আদেশের আলোকে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে সর্বশেষ সার্ভে পরিচালনা করা হয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত বড় কোনো সার্ভে হয়নি। তখন আদালত বলেন, দ্রুত সার্ভে পরিচালনা করুন এবং এই ইস্যুতে ন্যাশনাল ইমেজ জড়িত।
তানভীর আহমেদ আরও বলেন, ২০১৯ সালের ১২ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশা নিধনে দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের মাধ্যমে মশা নিধনে কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণ জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। প্রতিবেদন সংযুক্ত করে ওই রিটে একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওই আবেদন শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেন আদালত। তারই ধারাবাহিতায় আজ এ বিষয়ে শুনানি হয় এবং আদেশ দেন আদালত।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা শহরে মশক নিয়ন্ত্রণে অনেক কাজ হচ্ছে। কিন্তু তার আলোকে কোনো সুফল মিলছে না। এ কাজগুলো বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে বছরজুড়ে করতে পারলে কার্যকর সুফল মিলত। সেটা নিশ্চিত করতে পারছে না বলে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা তেমন কোনো কাজে আসছে না।
মশা বিষয়ক এ গবেষক যুগান্তরকে বলেন, কিউলেক্স মশা দমনে সিটি করপোরেশন অনেক তৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু, তাতে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ হয়নি। এ অবস্থায় কয়েক দফা বৃষ্টি এবং বাতাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কিউলেক্স অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে মশা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, যখন মশার লার্ভা ধ্বংস করার দরকার, তখন সেটা করা হচ্ছে না। এছাড়া রাজধানীতে কার্যকর ওষুধও ছিটানো হচ্ছে না। লার্ভা ধ্বংস না করলে মশা ধ্বংস হবে না।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো বোঝার পরও কেন জানি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। নিজস্ব কোনো জরিপও তাদের নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জরিপ করুক বা না করুক সিটি করপোরেশনের জরিপ কার্যক্রম থাকা দরকার।
এ সম্পর্কে নগর বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, প্লাস্টিক বর্জের কারণে রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহরূপ ধারণ করছে। দুই ভবনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা এক ধরনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সিটি করপোরেশন, সে পরিস্থিতি উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করছে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া কিউলেক্স ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রুটিন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির যুগান্তরকে বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এরপরও পরিস্থিতি যেন বৃদ্ধি না পায় সেজন্য জোর তৎপরতা পরিচালনা চালানো হচ্ছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণেও কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এ বছর গত বছরের ন্যায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হবে না। গত মার্চ থেকে এডিস মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।