আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

দুর্নীতি বন্ধ হলে ব্যয় সংকোচন সম্ভব

আসন্ন বাজেটে ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। করের হার না বাড়িয়ে আওতা সম্প্রসারণ করা জরুরি। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী ব্যয় কমিয়ে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। এছাড়া কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, দেশীয় শিল্প রক্ষা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হামিদ বিশ্বাস

যুগান্তর : বৈশ্বিক ও দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবার কেমন বাজেট হওয়া উচিত?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এবার গতানুগতিক বাজেটের সময় নয়। গাণিতিক হিসাবে আয়-ব্যয় মিলিয়ে দিলেই হবে না। বাজেটে যেন দেশের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে। আয় বাড়ানোর বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, আবার ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়াও চলমান রাখতে হবে। এর মধ্যে থেকে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেভাবেই বাজেটকে সাজাতে হবে। যাতে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করা যায়। বাজেটের আকার বড় হলে আপত্তি নেই। তবে আয়ের সংস্থান কোথা থেকে আসবে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে আয়কর জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি নয়। সেটা আরও বাড়াতে হবে। কর না বাড়িয়ে, করের আওতা বাড়াতে হবে।

সরকার এখন বলছে আমদানি বেশি হচ্ছে, এর বিপরীতে আয় বাড়ছে এটা একটা নেতিবাচক কথা। ভোগ্যপণ্য আসবে, ট্যাক্স বসাব, তারপর আয় বাড়বে। অথচ দেশের শিল্প নষ্ট হচ্ছে। ফরেন রিজার্ভ চলে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই। তাই এসব দিক দেখতে হবে। আপাতত আয়কর ও অন্যান্য খাতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। ভ্যাটের ওপর যথাসম্ভব গুরুত্ব কম দিতে হবে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ইতোমধ্যে মেগা প্রকল্পের জন্য বহু ঋণ নেওয়া আছে। এ খাতে আর ঋণ নেওয়ার দরকার নেই, অত্যাবশীয় কিছু বিষয় ছাড়া। যদি এডিপি থেকে বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকে সেগুলো এখনই কাটছাঁট করে দেওয়া উচিত। কারণ এগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো ফল পাওয়া যায় না।

যেসব প্রকল্প পাইপলাইনে আছে সেগুলোর দায়দেনা একটা সময় পরিশোধ করতে হবে। এখন যদি নতুন করে আরও প্রকল্প নেওয়া হয়। যে প্রকল্পের প্রয়োজনই নেই। এতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ ঠিকই হবে। কিন্তু তা উৎপাদনমুখী কোনো কাজে লাগবে না। এগুলোতে কর্মসংস্থানও হয় না। তাহলে এসব প্রকল্প নিয়ে তো ঋণের বোঝা বাড়ানো ঠিক হবে না। অভ্যন্তরীণ ঋণের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রে সুদ কমিয়ে দিচ্ছে এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কারণ এর ওপর নির্ভর করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশে বিকল্প আয়ের সংস্থান যেমন নেই, তেমনি নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। ফলে তারা কোথায় যাবে? এটা তো এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী।

যুগান্তর : বাজেটে ব্যয়ের খাত কেমন হওয়া উচিত?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এবার ব্যয়ের খাত নির্ধারণে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব মিতব্যয়ী হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী সব ব্যয় পরিহার করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গড়ে বরাদ্দ দেওয়ার পরিবর্তে যেখানে মানুষের কাজে লাগে সেসব খাতে বরাদ্দ দিতে হবে। বড় প্রকল্পে বারবার সময় বাড়ানো মোটেও ঠিক হবে না। বিশেষ করে দুর্নীতির দিকে বেশি নজর দিতে হবে। দুর্নীতি বন্ধ হলে ব্যয় সংকোচন সহজ হবে। মোট কথা ব্যয়ের দিকে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। অপ্রয়োজনে ব্যয় বাড়লে একদিকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়বে, অন্যদিকে মানুষের ওপর চাপ পড়বে।

যুগান্তর : দেশীয় শিল্প রক্ষায় কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাতে যথেষ্ট প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এতদিনে এ খাতটি দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারা দাঁড়াতে পারছে না বলে বারবার প্রণোদনা চাচ্ছে। এদিকে নজর দেওয়া দরকার। এ খাতে কতকাল প্রণোদনা দেওয়া হবে। খাতটিকে প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। তা না হলে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করার দিকে নজর দিতে হবে। কৃষিতে প্রণোদনা চালু রাখার পাশাপাশি আরও বাড়াতে হবে। কারণ কৃষক এমনিতে ন্যায্য দাম পায় না। তার মধ্যে যদি পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় তাহলে কৃষক সমস্যায় পড়বে। তখন তারা উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে। কৃষি উৎপাদন কমে গেলে আমদানি বাড়াতে হবে। তখন আরও সমস্যার সৃষ্টি হবে।

যুগান্তর : বাজেট বাস্তবায়নের হার বাড়াতে কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নে নীতি, কৌশলও থাকা উচিত। দেখা যায়, অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নে কোনো কৌশল নেওয়া হয়নি। ফলে নীতি প্রণয়ন করতেই ৬ মাস চলে যায়। একইভাবে প্রক্রিয়াগুলোও সহজ করতে হবে। প্রথম থেকেই নজরদারি শুরু করতে হবে। মাঝপথে এসে কম হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। এসব কারণে জোড়াতালি দিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। প্রথম থেকেই প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং জোরদার করতে হবে। তাহলে দ্রুত উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হবে।

যুগান্তর : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করণীয়?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : মূল্যস্ফীতির কারণে গরিব মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয়। মূল্যস্ফীতি এখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ আমদানির মাধ্যমে দেশে মূল্যস্ফীতিও আসছে। এসব ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক একা কিছু করতে পারবে না। সবপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে সেবা ও খাদ্য খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। খাদ্যেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে মানুষকে অনেকটা রক্ষা করা যাবে। সরকারের নানা অপচয় আছে সেগুলো বন্ধ করে ভর্তুকি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে আরও কঠোর হতে হবে।

যুগান্তর : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সব খাতে চাপ বাড়ছে। এটা কিভাবে মোকাবিলা করা যায়?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : জ্বালানি তেলের ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। খালি জ্বালানি খরচ বাড়িয়ে দিলে হবে না। এখানেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে না। এখানে অন্য খাত থেকে অর্থ এনে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। অন্যদিকে জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে।

যুগান্তর : রেমিট্যান্স বাবদ যে টাকা আসবে সেটির উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না-বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : এ ধরনের সুবিধা দেওয়া উচিত যারা নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠান তাদের জন্য। কারণ এখন অর্থ পাচারকারীরা আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাওয়ার জন্য পাচার হওয়া টাকা দেশে পাঠাবে। আবার কিছুদিন পর সেই টাকা বিদেশে পাচার করবে। আবার দেশে এনে প্রণোদনা নেবে। পাচার করা টাকা দেশে আনার বিষয়ে যদি কোনো সুযোগই দিতে হবে, তবে তার আগে এ অর্থ কিভাবে বিদেশে গেছে বা উৎস কি সেটা জানার পর তা যেন ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়। কোনো কিছু না জেনে শুধু টাকা ফেরত নিয়ে এলো, এটা যেন না হয়।

যুগান্তর : ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে, টাকার মান কমে যাচ্ছে-এটা কিভাবে দেখছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকদের জন্য সুবিধা হচ্ছে। তারা টাকা বেশি পাচ্ছে। রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রবাসীরাও বেশি টাকা পাবেন। তবে আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। অতএব এটা বাড়ালে যে রপ্তানি খুব বেশি উজ্জীবিত হবে তা না, রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এর প্রেক্ষিতে টাকার মান খুব বেশি নামিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। তাহলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যুগান্তর : বাজেটে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে সবার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি আরও বাড়াতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা বেরিয়ে গেলে পরে অব্যবস্থাপনা আবিষ্কার করলে হবে না-আগে থেকেই আবিষ্কার করতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিত ভিজিলেন্স, অডিটিং ও পরিদর্শন জোরদার করতে হবে। ঘটনা ঘটার আগেই যাতে নজরে আসে। শক্ত আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারগুলোর মধ্যে কিছু উলটাপালটা হয়েছে। এগুলো আগের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। পর্ষদে সদস্য সংখ্যা ও একই পরিবারের কতজন থাকতে পারবে সে ব্যাপারে বর্তমান নীতি সংশোধন করা দরকার। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেশ কিছু নতুন সংশোধনী আনতে হবে।

যুগান্তর : ব্যাংকের পরিচালকদের সুদ মওকুফের বিষয়ে উদারনীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এটা কীভাবে দেখছেন?

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ : সুদ মওকুফ করলে পরিচালকরা আরও উৎসাহিত হবে। ব্যাংকের পরিচালকদের প্রতি কেন এত উদারতা এটা জানি না। ব্যাংকিং খাতে এমনিতেই সুশাসনের ঘাটতি আছে, তার মধ্যে আবার পরিচালকদের এ সুযোগ দিয়ে আরও ঘাটতি বাড়ানো হচ্ছে। পরিচালকদের ব্যাপারে যথেষ্ট মনিটরিং করতে হবে।