আজকের পত্রিকা

দুদকের জালে কুষ্টিয়ার রাঘববোয়ালরা

দুদকের জালে কুষ্টিয়ার রাঘববোয়ালরা

কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে দুদক। দুই নেতা হলেন-কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি হাজি রবিউল ইসলাম এবং সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা। টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এসব সম্পদ অর্জন করেছেন তারা। এছাড়া স্কুল সংস্কারের কাজ না করে বিল ভাউচার দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খোকসা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল আকতারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। অবৈধ সম্পদ অর্জন করায় দুদকের জালে রয়েছেন জেলার আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা।

দুদকের একটি সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর হাজি রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদক প্রধান কার্যালয়ে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দেওয়া হয়। ওই অভিযোগে তার অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণ রয়েছে। তাতে রবিউল ইসলাম, তার স্ত্রী ও সন্তানরা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান কার্যালয় থেকে ৭ এপ্রিল তার সম্পদ বিবরণী চেয়ে নোটিশ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর দুদক কুষ্টিয়া কার্যালয় থেকে ১২ এপ্রিল হাজি রবিউল ইসলামকে নোটিশ করা হয়। তিনি নোটিশ গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে। তবে এখনো সম্পদ বিবরণী দাখিল করেননি। ২১ এপ্রিল সম্পদ বিবরণী দাখিল করার নির্ধারিত সময় থাকলেও তিনি সময় চেয়েছেন বলে জানা গেছে।

জানা যায়, দুদকের চিঠিতে হাজি রবিউল ইসলামের কাছে তার নিজের, স্ত্রী ও সন্তানদের পাসপোর্টের ফটোকপিসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি চাওয়া হয়েছে। এছাড়া তার নিজ, স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর নির্ভরশীলদের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জমি, প্লট, বাড়ি, ফ্ল্যাট, মার্কেট ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, খামার, ফার্ম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়া হাজি রবিউলের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে এফডিআর, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, গাড়িসহ অন্যান্য হিসাব চাওয়া হয়েছে।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, হাজি রবিউল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের একটি হিসাব তাদের হাতে আছে। তার দাখিল করা সম্পদের হিসাব মিলিয়ে দেখা হবে। এছাড়া জেলা পরিষদে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। এনআইডি কার্ড জালিয়াতি করে এর আগে শহরের একটি চক্র কোটি টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সেই ঘটনায় দুই আসামি জবানবন্দিতে হাজি রবিউলের নাম বলেছে।

অপরদিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা ও তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের এক হাজার একশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে এক হাজার কোটি টাকা ও তার স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাম্মী আরা পারভীনের বিরুদ্ধে একশ কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন কুষ্টিয়া কার্যালয়ের উপপরিচালক জাকারিয়া স্বাক্ষরিত একটি পত্র সরকারের সবগুলো দপ্তরে প্রেরণ করে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়। সব তথ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি ওইসব দপ্তর প্রেরণ করেছে। এখন সেগুলো যাচাই-বাছাই করে সঠিক মেরিট ধরে মামলা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

তবে অভিযোগ নাকচ করেছেন শিক্ষিকা শাম্মী আরা পারভীন এবং তার স্বামী আতাউর রহমান আতা। তারা বলছেন, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গ্রুপ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতেই পরিকল্পিতভাবে এসব অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বা অপ্রদর্শিত কোনো সম্পদ আমার নেই। দুদক মামলা করলে আমি তা মোকাবিলা করব।

দুদক সূত্রে জানা যায়, গত বছরের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকাস্থ দুদক সদর দপ্তরে আতাউর রহমান আতা ও তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনের বিরুদ্ধে তিন পাতার একটি অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগের ২৪ পয়েন্টে এই দম্পতির নামে কুষ্টিয়া ও ঢাকার বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং জমির বিবরণ তুলে ধরা হয়। এছাড়া কোন ব্যাংকের কত নম্বর অ্যাকাউন্টে কত টাকা জমা আছে এবং কত টাকার ডিপোজিট আছে তারও বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক জানতে পারে শাম্মী আরা পারভীনের বিভিন্ন ব্যাংকে চলমান নানা ধরনের সঞ্চয়ী স্কিম হিসাবে প্রায় অর্ধশত কোটি নগদ টাকা ছাড়াও উচ্চমূল্যের জায়গা-জমি, ভবন, মার্কেটসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য শতকোটি টাকা। একজন স্কুল শিক্ষিকার ব্যাংক হিসাবে একসঙ্গে জমাকৃত এত টাকার উৎসের সন্ধান শুরু করেছে দুদক। শাম্মী আরা পারভীনের অধিকাংশ ব্যাংক হিসাবের ট্রানজেকশনের সূত্র সন্ধানে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতার নাম উঠে আসে।

দুদকের নোটিশ সূত্রে আরও জানা যায়, চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা ও তার স্ত্রী শাম্মী আরা পারভীনকে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে দুদকের নির্দিষ্ট ছকে সব সম্পত্তি হিসাব দাখিল করতে বলা হয়। সমন্বিত জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাকারিয়া জানান, আতাউর রহমান আতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বালুমহাল ব্যবসা, হাট-বাজার ইজারা, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা খাত থেকে অর্জিত অবৈধ সম্পদের হিসাবে এক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। একইভাবে একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাম্মী আরা পারভীন স্বামীর রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ পন্থায় শতকোটির টাকার সম্পদ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তথ্য জানাতে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ৩০ মার্চ পত্র প্রেরণ করা হয়।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগের একটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত সময়কালে ২১টি বালুমহাল থেকে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আতাউর রহমান আত্মসাৎ করেছেন প্রায় সাড়ে ৬শ কোটি টাকা। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

জানা যায়, আতাউর রহমান ভেড়ামাড়া উপজেলার ষোলদাগ গ্রামের বাড়ি থেকে ২০১২ সালে কুষ্টিয়া শহরের মজমপুরের একটি ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। এরপর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমান মোমিজ এক ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার হলে আতাউর রহমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে ভারমুক্ত হন তিনি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত হন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অভিযোগ আছে, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। এছাড়া কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণে তার আর্থিক দুর্নীতি জেলার সর্বজনজ্ঞাত। এদিকে খোকসা উপজেলায় স্কুল সংস্কারের সরকারি অর্থ ব্যয় না করেই বিল ভাওচার দেখিয়ে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে উঠেছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল আকতারের বিরুদ্ধে। সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৯ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ বিশেষ আদালতে বাবুল আকতারসহ আরও সাতজনের নামে দুটি মামলা করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সমন্বিত দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা কার্যালয় কুষ্টিয়ার উপপরিচালক আলমগীর হোসেন।