আজকের পত্রিকা

সাইফুল আলম

তেইশ বছরে দৈনিক যুগান্তর এক চরৈবেতি অভিযাত্রা

পৃথিবীকে থমকে দেওয়া এক অতিমারির মধ্য দিয়ে আমরা পেরিয়ে এলাম আরেকটি বছর। এমন অভূতপূর্ব দুর্যোগ, এভাবে ইতঃপূর্বে আর কখনো মানবসভ্যতাকে থমকে দেয়নি, গতিহীন নিশ্চল করে দেয়নি। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে মানবজাতির এক অসম লড়াই, যা এখনো শেষ হয়নি। মানুষের ইতিহাস হচ্ছে-সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যোগ্যতমের টিকে থাকার ইতিহাস। সেই লড়াইয়ে আমরা টিকে থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি বটে;

কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় অভিযোজনের সক্ষমতা অর্জনের ওপর নির্ভর করছে অস্তিত্বের যোগ্যতা।

কারণ জীবনের মানেই হচ্ছে গতিশীলতা। গতিশীলতাই জীবনের মর্মকথা।

২.

করোনা মহামারি আমাদের অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে গেল। অমানবিক নিষ্ঠুরতা, ভয়ভীতি, সাহস, ভালোবাসা, সহমর্মিতা-তথা মানবীয় বোধের প্রতিটি অভিব্যক্তি যেন এক কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত হয়ে গেল আমাদের জীবনে। সবচেয়ে বেশি যা শিখিয়ে গেল তা হচ্ছে, পৃথিবীব্যাপী মানবজাতির অবিচ্ছিন্নতা। প্রাণ ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও অধিকার।

উপর্যুক্ত বৈশ্বিক বাস্তবতায় দৈনিক যুগান্তর তেইশ বছরে পদার্পণ করছে। করোনা মহামারিতে আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক আপন প্রিয়জনকে। হারিয়েছি দৈনিক যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রণী শিল্পোদ্যোক্তা শিল্পপতি নুরুল ইসলামকে। যিনি দেশকে বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত করার যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন ১৯৭১-এ। যুদ্ধোত্তর দেশে যিনি দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান, দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নিরলস কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন; সেই স্বপ্নদর্শী মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমরা আমাদের টিকে থাকার লড়াইয়ে নিরন্তর তার অনুপ্রেরণা এবং সাহসকে সঙ্গীরূপে পাশে পেয়েছি।

তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এবং তার সুযোগ্য উত্তরসূরি যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম ইসলাম ও পরিচালকবৃন্দের অকুণ্ঠ কর্ম অনুপ্রেরণায় অনেক প্রতিকূলতাকে উতরে অব্যাহত আমাদের এই পথচলা।

৩.

‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’ দৈনিক যুগান্তরের প্রায় দুই যুগছোঁয়া অভিযাত্রায় অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে আমাদের। আমরা আমাদের অঙ্গীকার ‘সত্যের পথে’ অবিচল, অবিচ্যুত থেকেছি। কেননা এখানেই আমাদের শক্তি। এই শক্তিবলেই আমরা পাঠকের অন্তরজুড়ে ঠাঁই পেয়েছি। পাঠকের আস্থাই একটি পত্রিকার প্রাণ-যুগান্তর পাঠকের সেই আস্থার প্রাণস্পন্দনে উত্তরোত্তর অগ্রযাত্রায় অনুপ্রেরণা পায়। যুগান্তর তার সম্পাদকীয় নীতি এবং আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি। ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক’ থাকতে গিয়ে অনেক সময়ই প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু আমরা দমে যাইনি।

‘সত্য’ এবং ‘সত্য-তথ্য’ সংবাদপত্রের প্রাণভোমরা, প্রাণশক্তি। যুগান্তর ওই প্রাণশক্তিকেই প্রতিফলিত করে পাঠকের চেতনায়। সঠিক এবং সত্য তথ্যের কোনো বিকল্প নেই। জনকল্যাণে এবং জনস্বার্থে, সঠিক পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সেই চেষ্টায় নিবেদিত ছিলাম, আছি।

বহু মত ও পথের বৈচিত্র্যকে ধারণ করাই সংবাদপত্রের লক্ষ্য। আমরা লালন করেছি সেই লক্ষ্যকে। আমরা জানি-একটি সংবাদপত্রকে জনগণের মুখপত্র হয়ে থাকার জন্য বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় হতে হবে। কেবল সংবাদ নয়, জনগণের নাড়ির স্পন্দন থাকতে হবে সার্বক্ষণিক।

করোনাকালে এবং করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক বাস্তবতা পৃথিবীর অনেক হিসাব-নিকাশই পালটে দিয়েছে-আমরাও এ বাস্তবতার বাইরে নই। গণমাধ্যমের অন্যতম সংবাদপত্র সবচেয়ে বেশি সংকটের সম্মুখীন। পত্রিকার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের ভুল ধারণায় একদিকে যেমন সংবাদপত্রের সার্কুলেশন কমেছে, বিজ্ঞাপন কমেছে, তেমনই অন্যদিকে বেড়েছে সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় প্রকাশনা উপকরণের মূল্য। যার ফলে অনেক সংবাদপত্র তার প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে দিয়েছে, অনেকে হারিয়ে গেছে। এ সংকটের তীব্রতা সংবাদপত্রসংশ্লিষ্টরা ছাড়া উপলব্ধি করা কঠিন। আমরা এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে প্রতিদিন অবতীর্ণ।

৪.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার এবং আদায় করে নেয়ার অধিকার মানুষের থাকবে, সঙ্গে সঙ্গে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধহয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’ (আমার দেখা নয়াচীন,

পৃষ্ঠা-১১৯)।

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর সঙ্গে সঙ্গে আমরা পালন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও। স্বাধীনতার এ পঞ্চাশ বছরেও আমরা এ দেশের মানুষের কাঙ্ক্ষিত ‘মুক্তি’ অর্জন করতে পারিনি। এ সত্যই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, স্বাধীনতার স্বপ্ন যারা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এ দেশের পরাধীন মানুষের চেতনায়, তাদের অন্যতম ড. রেহমান সোবহান। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকে আমরা শুধু স্বাধীনতা পেয়েছি; কিন্তু মুক্তি আজও পাইনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা পরাধীন হয়ে আছে। এখনো আমরা অন্যায্য সরকারব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি। শাসন পদ্ধতি ন্যায়সংগত নয়। পুরো ব্যবস্থায় একটি অন্যায্য সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতেও তা প্রকট।’ (বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২১তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রদত্ত প্রধান অতিথির বক্তৃতা)।

উপর্যুক্ত কারণেই আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহও হতে পারছে না। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের আশু লক্ষ্য এবং শপথ হওয়া প্রয়োজন জাতির পিতার অসমাপ্ত ‘মুক্তির সংগ্রাম’কে পূর্ণতা দেওয়া। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য কাজ করা।

৫০ বছর আগে যে বৈশ্বিক বাস্তবতায় একটি বর্বর হানাদার শক্তিকে পরাজিত করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সেই বৈশ্বিক বাস্তবতা আজ পরিবর্তিত হয়েছে। সে সময় পৃথিবীর সব শান্তিকামী মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে ‘মুক্তির সংগ্রামে’ বিজয় অর্জন করতে হলে সেই মুক্তিকামী স্বজনদের আমাদের সংগ্রামে শরিক করতে হবে। কেননা বৈশ্বিক ব্যবস্থা এখন আরও বেশি নিবিড়, নৈকট্যপূর্ণ, ওতপ্রোত। আমরা অস্ত্রের বিরুদ্ধে জিতেছি, বর্বরতার বিরুদ্ধে জিতেছি, মানবিকতা দিয়ে। তখন আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে জিতেছি। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে জিততে হবে আরও বৃহত্তর মানবিকতা দিয়ে। এখন আর লড়াই নেই, আছে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শত্রু নয়, প্রতিযোগী-প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাড়িয়ে যেতে হবে আমাদের অধিকতর শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা এবং মানবিকতা দিয়ে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কেউ আমাদের শত্রু নয়’ এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য, কেউ আমাদের ‘প্রভু’ও নয়। আমরা চাই সমতার বিশ্ব। সহমর্মিতার বিশ্ব। শান্তির বিশ্ব। এ চাওয়া আজ শুধু আমাদের নয়, এ চাওয়া গোটা পৃথিবীর মানবজাতির।

৫.

দেশের একজন জনপ্রিয় অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্দেশক, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সিপিডির এক আলোচনায় সভায় বলেন, ‘দেশে তথ্যের অন্ধত্ব বিরাজ করছে। তথ্য যে সহায়ক শক্তি হতে পারে, তা সরকার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপলব্ধি করছেন না। স্বল্প সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে তথ্যের কার্যকারিতা স্বীকার করার মনোভাব দেখা যাচ্ছে না।’

যুগান্তর ২২ বছর ধরেই তথ্যের এ অন্ধতা, বিকৃতি, বিভ্রান্তি দূরীকরণে ব্রতী ছিল। এজন্য আমরা অনেক বাধা-বিঘ্ন এবং স্বার্থান্বেষী মহলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হয়েছি। আমাদের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হয়েছে সত্য তথ্যকে গোপনের, উপেক্ষার। এসেছে নানা প্রলোভনও। আমরা বিচ্যুত হইনি। আমরা বেপথু হইনি।

৬.

‘বিদেশি রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হইয়া উঠিবে তাহা নহে। দেশকে আপন চেষ্টায় দেশ করিয়া গড়িয়া তুলিতে হয়।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সমূহ ব্যাধি ও প্রতিকার)।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এখনো কবির এ কথা সত্য বলে প্রতিভাত, জাজ্বল্যমান বটে। গত ৫০ বছরে আমরা উন্নয়নের অনেক সূচকে অগ্রগতি অর্জন করেছি। ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি; কিন্তু সেই যাত্রার পথে যেসব বিঘ্ন রয়েছে, তাও দূর করতে হবে।

গণতন্ত্র ও সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। বরং বলা চলে-এ দুটিই এখন উন্নয়নের অপরিহার্য সিঁড়ি। এই সিঁড়ি পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্য অর্জনে নিশ্চিত করতে হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে আজ অঙ্গাঙ্গি হয়ে গেছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধও। আমাদের প্রয়োজন প্রতিদিনের গণতন্ত্র; যে গণতন্ত্র প্রো-পিপল। জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রুটি-রুজির নিশ্চয়তা, জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি-এসব হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্রের শর্ত। গণতন্ত্র হচ্ছে সামনের দিকে এগিয়ে চলার অদম্য প্রেরণা, শক্তি। সবার সম্মিলিত শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞায় দেশকে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান এই তুমুল গতিশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে সবার অংশগ্রহণ এবং প্রচেষ্টা ছাড়া টিকে থাকাই দুরূহ বিষয়।

৭.

দৈনিক যুগান্তর আজ ২৩ বছরে পা রাখছে। সম্মানিত পাঠক, এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতারা আমাদের ওপর দীর্ঘকালব্যাপী যে আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন, আমরা তা অক্ষুণ্ন যেন রাখতে পারি, সেটাই প্রার্থনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটা মুক্ত সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নকে সার্থক রূপায়ণে ব্রতী থাকব-এটাই আমাদের জন্মক্ষণের অঙ্গীকার।

সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।

লেখক: সম্পাদক, যুগান্তর