এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠিত হয় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই চৌকস ইউনিট। সংস্থাটির ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে আজ। সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। এতে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্তকাজ সহজতর করতে ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি জানাবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। পাশাপাশি আরও ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। এছাড়া র্যাবের জন্য নতুন এবং অত্যাধুনিক যানবাহন কেনার দাবি জানানো হবে। র্যাবের উচ্চপর্যায়ের সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা র্যাব হেরিটেজ মিউজিয়াম ও বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্বোধন করবেন। এখন থেকে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরদিন র্যাব মেমোরিয়াল ডে পালন করা হবে।
র্যাবের একজন পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে র্যাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার আসামি গ্রেফতার করে। কিন্তু সেসব মামলার তদন্ত করার ক্ষেত্রে র্যাবের ক্ষমতা সীমিত। র্যাব ইচ্ছা করলেই মামলার তদন্ত করতে পারে না। মামলা তদন্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুমতি মেলে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুমতি মিলতে অনেক সময় লাগে। ঘটনার পর তদন্তের অনুমতি পেতে ৩-৬ মাস চলে গেলে ঘটনার গুরুত্ব অনেকটা হ্রাস পায়। অনেক আলামতও নষ্ট হয়ে যায়। এমনও দেখা যায়, যখন মামলাটি তদন্তের জন্য র্যাবকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার আগেই থানা পুলিশ বা অন্য সংস্থা চার্জশিট দিয়ে ফেলেছে বা তদন্ত শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তখন র্যাবের পক্ষে ওই মামলার তদন্তকাজ চালাতে গিয়ে অনেকাংশেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, থানায় কোনো মামলা হলে তাৎক্ষণিকভাবে থানার ওসিই একজন তদন্ত কর্মকর্তা ঠিক করে দেন। আমাদের দাবি, আমরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ আসামি গ্রেফতার করব, সেসব ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষমতা যেন ব্যাটালিয়ন প্রধানদের দেওয়া হয়। এটা সম্ভব না হলে অন্তত র্যাব সদর দপ্তরকে যেন তা দেওয়া হয়।
কাজের ক্ষেত্রে র্যাব কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে, জানতে চাইলে র্যাবের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান আইনে আমরা কোনো আসামি ধরার পর তাকে সরাসরি আদালতে উপস্থাপন করতে পারি না। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের মাধ্যমে আসামিকে থানায় হাজির করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় থানা পুলিশ আসামি গ্রহণ করতে চায় না। ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, সব আসামির বিরুদ্ধে আগে থেকে মামলা থাকে না। গ্রেফতারের পর অনেক সময় মামলা করতে হয়। অন্যদিকে আগে থেকে মামলা না থাকলে ওই আসামি থানা পুলিশ গ্রহণ করতে চায় না। তাই আমাদের বেশিরভাগ সময় এজাহারভুক্ত আসামিই ধরতে হয়। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আদালতের নির্দেশে একের পর এক মামলা তদন্তের জন্য র্যাবের কাছে আসছে। কিন্তু র্যাবের জনবল কম। যে হারে মামলা তদন্তের জন্য আদালত থেকে নির্দেশনা আসছে এতে র্যাবের মূল কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, ভুক্তভোগীর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ছোটখাটো মামলার তদন্তের দায়িত্বও র্যাবকে দিচ্ছেন আদালত। কিন্তু র্যাব চায় বড় বড় মামলার তদন্ত। এসব মামলার তদন্তের দায়িত্ব র্যাবকে খুব একটা দেওয়া হচ্ছে না।
অর্গানুগ্রাম অনুযায়ী, র্যাবের যখন সাতটি ব্যাটালিয়ন ছিল তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ১৩ জন। এখন র্যাবের ব্যাটালিয়ন ১৩টি। কিন্তু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন মাত্র তিনজন। এদের মধ্যে র্যাব সদর দপ্তরে দুজন এবং র্যাব-৪-এ একজন। এর আগে র্যাবে কখনো এত কমসংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতার করণে ভ্রাম্যমাণ অভিযান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
র্যাব জানায়, সংস্থাটিতে যেসব যানবাহন আছে সেগুলো খুবই পুরোনো। র্যাবের কোনো কোনো পরিচালক ২০০৪ সালের গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাই র্যাবের জন্য নতুন এবং অত্যাধুনিক গাড়ি কেনা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে র্যাব পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এখন থেকে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরদিন র্যাব মেমোরিয়াল ডে পালন করা হবে। সে অনুযায়ী এবার মেমোরিয়াল ডে হবে ২৯ মার্চ। এদিন র্যাব কর্মকর্তারা বিশেষ ব্যাচ পরবেন। কর্তব্য পালনরত অবস্থায় যেসব র্যাব সদস্য মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হবে। হারানো সহকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করবেন অনেকে। পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হবে সংবর্ধনা। তিনি বলেন, মেমোরিয়াল ডের বিশেষ ব্যাচ তৈরি করা হয়েছে লাল, হলুদ এবং কালো রংয়ের। লাল রংকে শহিদের রক্ত এবং হলুদ অপশক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, র্যাব সদর দপ্তরের নিচতলায় স্থাপন করা হচ্ছে র্যাব হেরিটেজ মিউজিয়াম। এতে ২৪টি অ্যানক্লুজার থাকবে। এর একটি হবে বঙ্গবন্ধু কর্নার। এছাড়া জঙ্গি দমন, মাদক নির্মূল, চরমপন্থি দমন, সুন্দরবন জলদস্যুমুক্তকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি এবং সাইবার ক্রাইম মোকাবিলাসহ র্যাবের নানা সফলতা তুলে ধরা হবে অন্যান্য অ্যানক্লুজারগুলোতে। অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ভিডিও চিত্র প্রদর্শনী এবং অধিনায়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় দিন মেমোরিয়াল ডে পালন শেষে সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
র্যাবের সফলতা তুলে ধরে সংস্থাটির উপপরিচালক মেজর রইসুল আজম মনি যুগান্তরকে বলেন, গেল এক বছরে র্যাব বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর তিন শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। সুন্দরবনে আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুদের মানবিক সহায়তা করা হয়েছে। এক বছরে ৮৫৩ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় এক হাজার ৩৪৪টি অস্ত্র, ২৮৫টি ম্যাগাজিন, আট হাজার ৭৪৮ রাউন্ড গোলা-বারুদ এবং বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক। ২০২১ সালে মাদকবিরোধী অভিযানে ১৫ হাজার ৫৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় এক কোটি ৬৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪৮৩ পিস ইয়াবা। এছাড়া বিপুল পরিমাণ অন্যান্য মাদক উদ্ধার করা হয়। গেল বছরে চাঞ্চল্যকর হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনায় ৪৮৫টি অভিযানে ৬৮৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব উপপরিচালক জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় র্যাব গত বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সময়ে ৭৮৭ জন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১১৪টি অভিযানে ৪৯৪ জন মানব পাচারকারী, ৩৩টি অভিযানে ২৭টি কিশোর গ্যাংয়ের ৪৫৪ সদস্য, ৩৮টি অভিযানে ৭৫ জন অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। চুরি, ছিনতাই এবং ডাকাতির অভিযোগে এক বছরে দুই হাজার ৫৮৩ জন অপরাধী গ্রেফতার করা হয়। দুই হাজার ৪১৫টি ভ্রাম্যমাণ অভিযানে ১২ হাজার ৭৪২টি মামলা করা হয়। এসব অভিযানে ৪৪ কোটি, ১৯ লাখ ২১ হাজার ৩১৯ টাকা জরিমানা ও ৯৮১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।