আজকের পত্রিকা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

টেস্ট বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট

দেশের সর্ববৃহৎ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ)। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এখানে নানা রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জাম প্রায় সময়ই থাকে বিকল। এছাড়া ২০ ভাগ পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থাই নেই। এই সুযোগে হাসপাতালের ভেতরেই গড়ে উঠেছে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের একটি শক্তিশালী চক্র। তাদের প্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে হাসপাতালের রোগীর নমুনা সংগ্রহ করছেন। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের রিসিটের মাধ্যমে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। এ প্রক্রিয়ায় অনেক অসাধু চিকিৎসকও জড়িত। তাদের কারসাজিতে এখানে ভর্তি রোগীর নমুনা চলে যাচ্ছে পাশেই গড়ে তোলা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ডিএমসিএইচ ঘিরে গড়ে ওঠা চিকিৎসক সিন্ডিকেটের এই ‘টেস্ট’ বাণিজ্য এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। ফলে উচ্চমূল্যে টেস্ট করাতে গিয়ে ওষুধ কেনার টাকা থাকছে না অনেক রোগীর। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হকের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়। তিনি বলেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কাছ থেকে প্রাইভেট ক্লিনিকের লোকদের নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি আইনসিদ্ধ নয়। একটি চক্র গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের বিভ্রান্ত করে এ কাজ করছে। অনেক সময় চক্রের সদস্যরা হাসপাতালের স্টাফ পরিচয়ে রোগীদের ফাঁদে ফেলছে। ক্যাশ টাকার লেনদেন হওয়ায় আমাদের কিছু লোকজনও এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শতকরা ৮০ ভাগ পরীক্ষা আমাদের এখানেই হয়। ২০ ভাগের সুযোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এজেন্টরা ঢুকে পড়ছে। ইদানীং এ কাজে চিকিৎসকদের একটি গ্রুপ সক্রিয় বলে শুনেছি। এটা তাদের নৈতিকতার পরাজয়। এসব বন্ধে আমরা নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। ইলেকট্রনিক মেডিকেল রিপোর্ট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা চালু করা গেলে বাইরের কোনো প্যাথলজি রিপোর্ট যখন আমাদের সফটওয়্যারে আপলোড হবে না তখন এমনিতেই এই চক্রটির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে। আপাতত আমরা এন্ট্রি পয়েন্টগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করছি। এছাড়া কিছুদিন পরপরই র‌্যাব অভিযান চালায়। তারা দালালচক্র ও অবৈধ কাজে জড়িতদের ধরে নিয়ে যায়। জেল-জরিমানা করে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকার বাসিন্দা ইউনুস আলীর কিশোরী মেয়ে ইরিনা ভর্তি আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে। পেটে ব্যথা অনুভব করলে তার ব্লাড, ইউরিনসহ বেশ কিছু টেস্ট করাতে বলেন চিকিৎসক। যেগুলো ডিএমসিএইচে হয়ে থাকে। কিন্তু ইউনুস আলী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইরিনার বেডের পাশে হাজির রোকন নামের এক যুবক। তিনি চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী নমুনা সংগ্রহ করেন। ইরিনা তখনো জানেন না রোকন হাসপাতালের স্টাফ নাকি, বহিরাগত। নমুনা সংগ্রহের পরও ইরিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেননি রোকনের আসল পরিচয়। তারা শুধু জানেন, সবুজ শার্ট পরা রোকন নামের এক লোক ইরিনার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। ইউনুস আলী জানান, এই পরীক্ষা বাবদ ৩ হাজার ৪০০ টাকার একটি বিল তার হাতে ধরিয়ে ২ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে গেছেন রোকন। পুরো বিল পরিশোধের সময় কিছু ডিসকাউন্ট দেওয়া হবে বলেও জানিয়ে গেছেন।

ইরিনার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহকারী রোকনের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, তিনি পাশের অথেনটিক ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন লিমিটেডের কর্মী। এই প্রতিষ্ঠানের একটি ক্যাশ ভাউচারে কপি পাওয়া যায় ইরিনার বাবার কাছে। ২৫ জানুয়ারি রোকনের সই করা ভাউচারে রোগীর পরিচয় ও ঠিকানা লেখা আছে, মিস ইরিনা, ডিএমসিএইচ, ওয়ার্ড ৭০১, বয়স ১৭। ক্যাশ ভাউচারে মোট ৩ হাজার ৪৪০ টাকা বিলের মধ্যে ২ হাজার টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। এরপর ভাউচারে দেওয়া মোবাইল ফোন নম্বরে এ প্রতিনিধির কথা হয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, সরকারি হাসপাতালের ভেতর থেকে প্রকাশ্যে কীভাবে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেন। আর এ কাজ বৈধ কিনা-জবাবে তিনি বলেন, তারা নিজের ইচ্ছায় নমুনা আনেন না। রোগীরা তাদের ডাকলে যান। তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে নমুনা সংগ্রহকারী হিসাবে চাকরি করেন বলেও স্বীকার করেন।

আরও জানা গেছে, রোকন একা নন, অথেনটিক ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন লিমিটেডের অন্তত ২০ জন কর্মী হাসপাতালের ১২টি ওয়ার্ডে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের রয়েছে নিজস্ব ড্রেসকোট। এছাড়া পপুলার, পিওর সায়েন্টিফিক, হেলথ এইড, ঢাকা ডায়াগনস্টিক নামের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের হাসপাতালের ভেতর থেকে রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্সদের সামনেই তারা রোগীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। তারা হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সদের মতোই পালাক্রমে ডিউটি করেন। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে রোগীর ব্যক্তিগত ফাইল ঘেঁটে চিকিৎসকদের চিকিৎসাপত্র দেখেন। তাতে টেস্ট করানোর নির্দেশনা থাকলেই স্বজনদের ফুসলিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। ওয়ার্ডের এক কোণেই রাখেন তাদের নমুনা সংগ্রহের সরঞ্জাম। যেন সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি ক্লিনিকের সাব অফিস-এমন মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। আবার অনেক চিকিৎসক কোথা থেকে টেস্ট করাতে হবে তা সরাসরি রোগীর স্বজনদের বলেই দেন। এ কাজে ডিএমসিএইচ ঘিরে অসাধু চিকিৎসকদের একটি সিন্ডিকেটও গড়ে উঠছে। এই সিন্ডিকেটের হোতারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পছন্দের চিকিৎসকদের এনে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দিচ্ছেন। এই পদের একজন চিকিৎসকের অধীনে দুটি ওয়ার্ড পরিচালিত হয়। তারাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন নিজ নিজ ওয়ার্ডের টেস্ট বাণিজ্য। অতি সম্প্রতি মেডিসিন বিভাগে চারজন চিকিৎসককে বসানো হয়েছে। তারাও টেস্ট বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। চিকিৎসকরা জড়িত থাকায় এই চক্রের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে হাসপাতালের অন্য স্টাফরাও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পান না।

একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে এসব চিকিৎসক পপুলার, ল্যাবএইডে রোগী পাঠাতেন। এখন তারা নিজেরাই ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছেন। ২০০ পার্সেন্ট লাভের ব্যাবসায় নেমে অনেক চিকিৎসক নিজেদের পরিচয় ভুলে গিয়ে ব্যবসায়ীদের মতো মুনাফার লোভে যা খুশি তাই করছেন। এদের কারসাজিতেই হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবে সব সময় সংকট লেগেই থাকে।

টেস্ট বাণিজ্যে চিকিৎসকদের জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি, স্বাচিপের সাবেক নেতা ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটুর সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস চালু করা গেলে এ সমস্যা বহুলাংশে লাঘব করা সম্ভব । এতে সরকারি হাসপাতালের রোগী বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর বন্ধ হবে। অফিস সময়ের পর রোগীরা সরকারি হাসপাতালেই আউটডোর ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা পাবেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি ক্লিনিকের লোকজনদের নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি দৃষ্টিকটু। আইনসিদ্ধও নয়। তারপরও সিস্টেমের কারণে এটা চলছে। সরকারি হাসপাতালের সক্ষমতার অভাব ও কর্মী সংকটের কারণে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আড়ালে থেকে ডিএমসিএইচকেন্দ্রিক চক্রের মদদ দেন সরকারি দলের একজন চিকিৎসক নেতা। তিনি সাবেক সংসদ সংসদ্য। আর প্রকাশ্যে চক্রের বড় অংশের নিয়ন্ত্রক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আফজালুল হক রানা। এই চক্রের সদস্যদের মালিকানায় ঢাকা মেডিকেল সংলগ্ন রাস্তার পাশে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনে সহযোগিতা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিতর্কিত একজন কর্মকর্তা। ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি যখন স্থাপন করা হয় তখন তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক, হাসপাতাল অ্যান্ড ক্লিনিক পদে দায়িত্বে ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে। বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি করোনা টেস্ট বাণিজ্যও করছে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা মেডিকেলে করোনা টেস্ট ফ্রি করা হলেও এখান থেকে রোগীদের ভাগিয়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় করোনা টেস্ট করছে তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তার সহযোগিতায় করোনা টেস্টের অনুমোদন নিয়ে বসানো হয়েছে আরটিপিসিআর মেশিন। তবে তাদের টেস্টের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অথেনটিক ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন লিমিটেডের পরিচালক আফজালুল হক রানা বলেন, ঢাকা মেডিকেলের অধিকাংশ রোগীই গরিব। তাদের কাছে আর কত টাকা থাকে। যে তাদের ভাগিয়ে এনে ভর্তি করা হবে। রোগী ভাগানোর বিষয়টি ইমপসিবল। রোগীদের অনুরোধে অনকলে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আমরা যেহেতু হোম সার্ভিস দিই, তাই হাসপাতাল থেকেও আনি। আর এটা শুধু আমরা একা করি না। পপুলারসহ অনেকেই ঢাকা মেডিকেলে কাজ করছে।

প্রসঙ্গত, সরকারি হাসপাতালের ২০০ গজের মধ্যে কোনো বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করা যাবে না-এমন একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই উদ্যোগ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা সরেজমিন দেখা গেছে, ডিএমসিএইচের ২০০ গজের কম দূরত্বে গড়ে উঠেছে অথেনটিক ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন লি., হেলথ এইড ডায়াগনিস্টিক সেন্টার, পিওর সায়েন্টিফিক ডায়াগনস্টিক সার্ভিসেস, ঢাকা ডায়াগনস্টিকসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। এদের এজেন্ট, দালালরা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি রোগীদের টেস্ট বাণিজ্য এবং রোগী ভাগানোর কাজ করে। ঢাকা মেডিকেলের ভেতরে ও বাইরে তাদের তৎপরতা দেখা যায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিঞা যুগান্তরকে বলেন, সরকারি হাসপাতালের ২০০ গজের ভেতর কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক করা যাবে না মর্মে একটি প্রস্তাব অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অবৈধ। কেউ যদি আমাদের কাছে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করে অবশ্যই তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।