আজকের পত্রিকা

কতদিন টিকবেন শাহবাজ শরিফ?

কতদিন টিকবেন শাহবাজ শরিফ?

বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘ ২৪ বছর (১৯৪৭-১৯৭১) কায়েমি ঔপনিবেশিক শাসন আর শাসনের নামে শোষণ চালিয়ে যায় পাকিস্তান। শুরু থেকেই সেনাবাহিনী দেশ শাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে দাঁড়ায়। জেনারেলরা ক্রমে ক্ষমতায় আসক্ত হয়ে ওঠেন, সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন আমলারাও।

লিয়াকত আলী খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৪৭-১৯৫১)। আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিন বছরের বেশি সময় (৩৮ মাস) তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। রাষ্ট্র হিসাবে পথচলার শুরুতে সাতজনের মধ্যে লিয়াকত আলী খান ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশিদিনের প্রধানমন্ত্রী। লিয়াকত আলী হত্যাকাণ্ডের পর তার স্থলাভিসিক্ত হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন (১৯৫১-১৯৫৩)। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে খাজা নাজিমুদ্দিনের আয়ুষ্কাল ছিল দেড় বছর (১৮ মাস)। মোহাম্মদ আলী বগুড়া ছিলেন পাকিস্তানের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৩-১৯৫৫)। তিনি পদাসীন ছিলেন দুই বছর (২৪ মাস)। মোহাম্মদ আলী বগুড়ার পর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী (১৯৫৫-১৯৫৬)। তিনি পাকিস্তানের ১৪ মাসের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৬-১৯৫৭)। মাত্র এক বছরের (১৩ মাস) মাথায় অন্যায়ভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পদচ্যুত করা হয়। সোহরাওয়ার্দীর পর প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্ড্রিগড় (১৯৫৭)। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মাত্র তিন মাস ছিল চুন্ড্রিগড়ের স্থায়িত্বকাল। অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মালিক ফিরোজ খান নূন (১৯৫৭-১৯৫৮)। নয় মাস ছিল তার প্রধানমন্ত্রিত্বের আয়ুষ্কাল।

৭ অক্টোবর ১৯৫৮ গভীর রাতে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট আর দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানকে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক দুজন সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ইস্কান্দার মির্জা ২৫ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খানকে উজিরে আজম বা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে তার নেতৃত্বে ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কাশ্মীর ও দেশরক্ষা দপ্তর অর্পিত হয় আইয়ুব খানের ওপর। আইয়ুব খান ছিলেন পাকিস্তানের তিন দিনের (২৫-২৭ অক্টোবর ১৯৫৮) প্রধানমন্ত্রী।

নতুন ব্যবস্থা অর্থাৎ সামরিক শাসন শুরু করার মাত্র দুই-তিন সপ্তাহ যেতে না যেতেই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এবং প্রধানমন্ত্রী (উজিরে আজম) ও সামরিক শাসনকর্তা মোহাম্মদ আইয়ুব খানের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে মতবিরোধ তুঙ্গে উঠে। আইয়ুব খান ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২১ অক্টোবর তাকে শাহবাগ হোটেলে (স্বাধীনতা লাভের পর যা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং আশির দশকে হোটেল শেরাটন নামে অভিহিত) ঘটা করে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পরদিন ২২ অক্টোবর ঢাকা স্টেডিয়ামে আনুমানিক দেড় লাখ লোকের এক বিশাল সমাবেশে তিনি ভাষণ দেন।

কথায় বলে এক বনে দুই বাঘের স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা বড় দায়। ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খানের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রয়োগ ও মতাদর্শ নিয়ে উভয়ের মধ্যে শিগ্গির বিরোধ দেখা দেয় এবং অল্পসময়ের মধ্যে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। আইয়ুব খানের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের মাত্রাটি ক্রমে সীমা ছাড়াতে থাকে। দ্বৈতশাসনের বিষয়টি সর্বত্র পরিদৃষ্ট ও আলোচিত-সমালোচিত হতে থাকে। এভাবে গড়াতে থাকে দিনক্ষণ। শেষ পর্যন্ত আইয়ুবের কূটচালের কাছে হেরে যান ইস্কান্দার মির্জা। সামরিক শাসন জারির মাত্র ২০ দিনের মাথায় (৭-২৭ অক্টোবর ১৯৫৮) প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান মির্জা এবং আইয়ুবের কাছে সব ক্ষমতা ন্যস্ত করেন। রাতেই একটি বিমান সপরিবারে মির্জাকে বহন করে লন্ডনের উদ্দেশে রাজধানী করাচি ছেড়ে যায়। এসব নাটকীয়তার ভিতর দিয়ে আইয়ুব খান পাকিস্তানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে উঠেন। আর দেশবাসীর মন থেকে দ্বৈত-কর্তৃত্বেরও অবসান ঘটে।

২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ প্রধানমন্ত্রী পদটি বিলুপ্ত বলে ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৮ সালের পর ১৪ বছরের মধ্যে (১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় ও পাকিস্তানের পরাজয় পর্যন্ত) আর কাউকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়নি। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘পরিবর্তিত’ পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন।

সম্প্রতি পদচ্যুত ইমরান খান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী (১৮ আগস্ট ২০১৮-৯ এপ্রিল ২০২২) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাস বড় কঠিন ও নির্দয়। পাকিস্তানের নির্বাচিত-অনির্বাচিত মোট ২২ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কারও পক্ষেই পুরো মেয়াদ টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতার পালাবদলে একে একে সবাইকে অপ্রত্যাশিত ‘নিষ্ঠুর পরিণাম’ বরণ করে নিতে হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান মুসলিম লীগের (এন) শাহবাজ শরিফ গত ১১ এপ্রিল ২৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি কতদূর যান, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক