দৃষ্টিপাত

ঈদযাত্রা

ঈদযাত্রা: এবার কী হবে?

আর কয়েকদিন পরেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রতি বছরের মতো ঢাকা ও আশপাশের জেলা ছাড়বে প্রায় দেড় কোটি মানুষ মানুষ। তবে এবার ঘরমুখী মানুষের চাপ অন্যান্য বারের তুলনায় একটু বেশিই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক কথায় ঘরমুখো মানুষের ঢল নামবে এবার।

বিগত দুই বছর অতিমারি করোনার কারণে অনেকে ঢাকা ত্যাগ করেনি। ফলে এবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালনে বাড়িতে যেতেই হবে তাদের। মা-মাটি আর নাড়ির টানে গ্রামে যেতে উদগ্রীব যান্ত্রিক শহরগুলোর মানুষ। এসব মানুষের চাপ পড়বে বাস-ট্রেন-লঞ্চে। আর এ চাপ কী সামলানো যাবে?

এবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি শুরু হয়েছে দেরিতে; অফিস-আদালতেও প্রায় একইসঙ্গে ছুটি শুরু হয়ে যাবে। ঈদে এবার লম্বা ছুটি পেতে যাচ্ছে চাকরিজীবীরা। এই সুযোগে অনেকে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। সঙ্গে রয়েছে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা; তাদের সিংহভাব ঢাকা ছাড়বে। এসব চাপ প্রায়ই একইসঙ্গে পড়বে সড়ক ও নদী পথে। এছাড়া দুর্যোগ মৌসুমেই উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির ঈদ-পূর্ব এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ঈদে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনসহ এ তিন জেলা থেকে প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্বজনদের কাছে যায়। এবার সেই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা। আর এসব মানুষ ঢাকা ছাড়বে বাস, ট্রেন ও লঞ্চে। ফলে এ তিন রুটে অসহনীয় চাপ পড়বে। বাড়বে ভোগান্তিও।

রাজধানী থেকে বের হওয়ার সড়কগুলো কমবেশি ভাঙাচোরা হয়ে পড়েছে। কোথাও মেরামতের কাজও চলছে; কোথাও চলছে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। বিআরটি প্রকল্পের আওতায় সড়ক উন্নয়ন কাজ চলায় উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ভাঙাচোরা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা টঙ্গী এলাকায় ভোগান্তিতে পড়ছেন। নবীনগর পর্যন্ত মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সংস্কার কাজ চলছে। সেতু মেরামতের কারণে সড়ক সরু হয়ে দুই লেনে পরিণত হয়েছে। এর পর বাড়তি গাড়ির চাপ পড়লে কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে- তা সহজেই অনুমেয়।

পরিবহণসংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদযাত্রা শুরু না হলেও ঢাকা থেকে বের হতেই পথে পথে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ঈদের বাড়তি গাড়ি রাস্তায় নামলে যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় পুলিশের তৎপরতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে ঈদের আগে সড়ক নির্মাণ শেষ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রতি ঈদে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের চারটি সিটি করপোরেশনসহ এ তিন জেলা থেকে প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্বজনদের কাছে যায়। তাদের ২৫ শতাংশ যায় নৌপথে। আর সড়ক ও রেলপথে যায় যথাক্রমে ৫৫ ও ২০ শতাংশ। এই হিসেবে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ যায় লঞ্চসহ বিভিন্ন ধরনের নৌযানে। তবে নিয়মিত দুর্ঘটনা, দূরপাল্লার সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বেহাল দশা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের প্রধান দুটি মাধ্যম শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ফেরিস্বল্পতা ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকেই সড়কপথ এড়ানোর চেষ্টা করবেন। এর বিপরীতে নৌপথে নৌপথে যাত্রীসংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪০ লাখ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নদ-নদী, নৌ পরিবহন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সড়ক, রেল ও নৌদুর্ঘটনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেসরকারি সংগঠনটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২৯ এপ্রিল থেকে ঈদের দাপ্তরিক ছুটি শুরু হলেও ২১ এপ্রিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধের দিন থেকেই মূলত: ঈদযাত্রা শুরু হবে। তাই ওইদিন থেকে ২ মে পর্যন্ত ১২ দিনে ৪০ লাখ যাত্রী সুশৃঙ্খলভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার সক্ষমতা নৌখাতে নেই। তবে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির কারণে সব বাধা উপেক্ষা করেই স্বজনদের সান্নিধ্যপ্রত্যাশীরা ছুটে যাবেন। এতে টার্মিনালে যেমন মারাত্মক অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হবে, তেমনি লঞ্চের ছাদসহ ডেকে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হবে।

এছাড়া এবার দুর্যোগ মৌসুমেই উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ কারণে যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও রয়েছে। তাই নৌপথে নিরাপদ ঈদযাত্রার জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কমিটি।

শুধু ঈদযাত্রা নয়, বছরের প্রায় সময়ই সব থেকে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ফেরিঘাটে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয় পারাপারের জন্য। ঈদের আগে তা অসহণীয় পর্যায়ে পড়ে। আর এ বছর ফেরি সংকটে এ ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে তুলবে।

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ার কারণে চলতি রমজান মাসের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিন নদীপারের অপেক্ষায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি সৃষ্টি হয়ে আসছে। নদী পারের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় আটকে থাকা যানবাহনের যাত্রী ও চালকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই দুর্ভোগ আসন্ন ঈদে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

সূত্রমতে, নদী পারাপার হতে আসা যানবাহনের তুলনায় নৌরুটে ফেরি সংকট, নদীতে নাব্যতা সংকট ও ঘাট সংকটে মূলত যানবাহন পারাপার ব্যহত হচ্ছে। পদ্মা নদী পাড়ি দিতে ফেরির নাগাল পেতে মহাসড়কে প্রতিদিনই পণ্যবাহী ট্রাক, যাত্রীবাহী যানবাহনের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ সারিতে আটকে থাকতে হচ্ছে। ঈদের আগে কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।

একই অবস্থা হবে বাংলাবাজার শিমুলিয়া নৌ পথ ব্যবহারকারীদেরও। গত বছর থেকে এই নৌ পথে ফেরি চলাচল কমিয়ে এই নৌ পথে ৫-৬টি ফেরি চলাচল করে। তবে এবারের ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করে শরিয়তপুরের মাঝিকান্দি এলাকায় বিকল্প একটি ফেরি ঘাট স্থাপন করা হয়েছে। শিমুলিয়া থেকে মাঝিকান্দি ও বাংলাবাজার নৌ পথে ঈদ উপলক্ষে ১০টি ফেরি চলাচল করবে। যা চাহিদার তুলনায় খুবেই কম। ফলে আসন্ন ঈদেও ফেরিতে বড় ধরনের দুর্ভোগের শঙ্কা রয়েই গেছে।

এদিকে উত্তরবঙ্গের মানুষেরও এবার বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরতে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় সংযোগ মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় তাদের জন্যও এবারের ঈদযাত্রা খুব বেশি স্বস্তির হবে না। তবে এসব সড়কে এবার দুর্ভোগ কমাতে আগেভাগেই কাজ শুরু করেছে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা।

ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়কের জরাজীর্ণ পুরাতন নলকা সেতুর পাশেই নবনির্মিত সেতুর এক লেন খুলে দেওয়া হচ্ছে সোমবার। এটি উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গগামী ২২ জেলার মানুষের যাতায়াতের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া চারলেন মহাসড়ক নির্মাণ কাজের জন্য মহাসড়কের কড্ডার মোড়, নলকা সেতু, হাটিকুমরুল গোলচত্বর ও চান্দাইকোনা এলাকার বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট অসংখ্য খানাখন্দ সংস্কার করা হয়েছে। এতে এবারের ঈদযাত্রায় অনেকটাই স্বস্তি ফিরে আসবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে ঈদের ছুটি শুরু হলে যাতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি না হয়, সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ ও সড়ক বিভাগ। পাশাপাশি যানজট হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবে রাস্তার পাশে অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে যানবাহনগুলো চার লেন সড়কের সুবিধায় টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে পারে। কিন্তু এলেঙ্গার পর থেকে সেতু পর্যন্ত সড়ক দুইলেন। চার লেনের যানবাহন দুই লেন সড়কে প্রবেশের সময় যানজটের সৃষ্টি হয়। এবার এলেঙ্গা থেকে সেতুর টোল প্লাজার কাছে গোল চত্বর পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার একমুখী (ওয়ানওয়ে) করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এলেঙ্গা থেকে এই সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী যানবাহন চলবে। আর উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী যানবাহন সেতু পার হওয়ার পর বিকল্প সড়ক হিসেবে গোলচত্বর থেকে উত্তর দিকে ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত আসবে।

তবে ঈদুল ফিতরের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ততই শঙ্কা বাড়ছে নাড়ির টানে ঘরমুখো মানুষের। একটু এদিক ওদিক হলেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে যাওয়া মানুষের যাত্রাপথে নামতে পারে মহাবিপর্যয়।