ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) বেশি হারে ভোট পড়ার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ষষ্ঠ ধাপের ২০৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ৯৪টিতেই ৭০ শতাংশের বেশি হারে ভোট পড়েছে। এর মধ্যে ২৫টিতে ৮০ থেকে ৮৮ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। ৭৬ থেকে ৭৯ শতাংশ ভোট পড়েছে আরও ২৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। আর ৭১ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৪৪টিতে। সার্বিকভাবে ৯৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ইভিএমেই ৭০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে। বাকি ১১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ৫৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে। কোনো ইউনিয়ন পরিষদেই ৫০ ভাগের কম ভোট পড়েনি। ষষ্ঠ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে ভোট পড়ার এ হারকে স্বাভাবিক বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইভিএমে এত বেশি হারে ভোট পড়ায় তারা হতবাক। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এবারই প্রথম সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদে ইভিএমে এত বেশি হারে ভোট পড়ল। এর আগে স্থানীয় সরকারের একটি নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। অথচ ষষ্ঠ ধাপে ৫টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট পড়েছে ৮৫ থেকে ৮৮ শতাংশ। তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ইভিএমে ভোটগ্রহণের ধীরগতির অভিযোগ ছিল। অনেক ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণের সময়ে আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোট দিতে ব্যর্থ হয়ে অনেক নাগরিক ফিরে গেছেন। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার এ নির্বাচনে ৫০-৫৫ শতাংশ ভোট পড়তে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। মঙ্গলবার প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, ইসির ওই ধারণা ভেঙে দিয়ে এ ধাপে ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। এ ধাপে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ১১৭, স্বতন্ত্ররা ৯৫, জাতীয় পার্টি তিনটি ও জাতীয় পার্টি (জেপি) একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার যুগান্তরকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইভিএমে যে হারে ভোট পড়েছে তা স্বাভাবিক। গতকাল (সোমবার) যখন আমি সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছিলাম তখন আমার কাছে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ভোটের প্রাথমিক হিসাব ছিল। এ কারণে আমি ৫৫ শতাংশ ভোট পড়তে পারে বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক ইউনিয়নে ভোটার থাকায় নির্ধারিত সময়ের পরও ভোট পড়েছে। এ কারণে ভোট পড়ার হার বেড়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট পড়ার গতি কমের অভিযোগ রয়েছে। আমরা বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে পর্যালোচনা করব। এছাড়া কারিগরি কমিটির বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ছয়টি ধাপের তিন হাজার ৯২০টি ইউনিয়ন পরিষদের ফল পাওয়া গেছে। সার্বিক ফলাফলে দুই হাজার ১৩৭টিতে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। অপরদিকে স্বতন্ত্ররা জয়ী হয়েছেন এক হাজার ৬৯৬টিতে। বাকিগুলোতে অন্যান্য দলের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ৩৬০টি ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন; যাদের মধ্যে ৩৫৫ জনই আওয়ামী লীগের। বাকিরা অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র।
ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচন: এ ধাপে ২১৯টিতে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। আইনগত ও অন্যান্য জটিলতায় পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। অন্য ধাপের স্থগিত দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যুক্ত হয় এ ধাপে। এছাড়া ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। এসব বাদ দিয়ে সোমবার ২০৮টিতে ভোট হয়। এতে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে ৭০ থেকে ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ৯ থেকে ১১টি করে কেন্দ্র ছিল।
জানা গেছে, বগুড়া সদর উপজেলার ফাঁপোড় ইউনিয়ন পরিষদে ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ ইউনিয়ন পরিষদে ৯ হাজার ৩৩৭টি ভোটের মধ্যে পড়েছে ৮ হাজার ২০৫টি। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মেহেদী হাসান দুই হাজার ৮৬ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. রেজাউল হক পেয়েছেন দুই হাজার ৬২ ভোট। একই উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদে ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। এ ইউনিয়ন পরিষদেও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. রাজিবুল ইসলাম খান জয়ী হয়েছেন। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ঝলইশালশিরি ইউনিয়ন পরিষদেও ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. আবুল হোসেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। একই জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীডুবা ইউনিয়ন পরিষদে ভোট পড়েছে ৮৪ শতাংশ। এছাড়া কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার সদর ও শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সদর ইউনিয়নে ৮৬ শতাংশ হারে ভোট পড়েছে। এ ধাপে সবচেয়ে কম ৫৫ শতাংশ ভোট পড়েছে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইল ইউনিয়ন পরিষদে।
যেসব কেন্দ্রে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট: পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন পরিষদে ৮৪ শতাংশ, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট সদরে ৮০ শতাংশ, সদর উপজেলার কমলপুরে ৮০ শতাংশ, ফাজিলপুরে ৮১ শতাংশ, শংকরপুরে ৮০ শতাংশ ও সন্দরবনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদে ৮০ শতাংশ, বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়ায় ৮১ শতাংশ ও ভোটনগরে ৮২ শতাংশ, রংপুরের পীরগঞ্জের বড় আলমপুরে ৮২ শতাংশ, কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার অষ্টমীরচরে ৮৪ শতাংশ ও চিলমারী সদরে ৮৬ শতাংশ এবং ভুরঙ্গামারী উপজেলার শিলখুড়ি ইউনিয়ন পরিষদে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলর চন্দননগরে ৮৪ শতাংশ, রসুলপুরে ৮০ শতাংশ ও হাজীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে ৮১ শতাংশ, শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা ইউনিয়ন পরিষদে ৮১ শতাংশ ভোট পড়েছে।
কোন ধাপে কত জয়ী: এ পর্যন্ত ছয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। ষষ্ঠ ধাপে আওয়ামী লীগ ১১৭টি ও স্বতন্ত্ররা ৯৫টিতে জয়ী হয়েছেন। এর আগে পঞ্চম ধাপে স্বতন্ত্ররা ৩৪৬ ও আওয়ামী লীগ ৩৪১ জন, চতুর্থ ধাপে আওয়ামী লীগ ৪০১ ও স্বতন্ত্ররা ৩৯৬টিতে জয়ী হন। এর আগে প্রথম ধাপে ২৬৭, দ্বিতীয় ধাপে ৪৮৬ ও তৃতীয় ধাপে ৫২৫ জন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হন। অন্যদিকে স্বতন্ত্ররা প্রথম ধাপ ৮৫টি, দ্বিতীয় ধাপে ৩৩০ ও তৃতীয় ধাপে ৪৪৬টিতে জয়ী হন। ৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তম ও শেষ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।