আজকের পত্রিকা

ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়া কি জরুরি?

ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়া কি জরুরি?

গত ২১ জুন থেকে দেশে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন শুরু হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপে তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় গত ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ ধাপে মোট ৮৬ জন লোকের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আহত হয়েছে আরও প্রায় কয়েক শ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে যে আরও কয়েক দফা নির্বাচন অনুষ্ঠান এখনো বাকি আছে, সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর এ সংখ্যা আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের কোনো ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে এত বেশিসংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা এই প্রথম। জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কমবেশি রয়েছে, বিশেষত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয়। কিন্তু তাই বলে নির্বাচনের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতেই সহিংসতায় ইতোমধ্যে ৮৬ জন মানুষের মৃত্যু! এটি কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? এ তো এক পৈশাচিক অমানবিকতা। কিন্তু এ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনকে তো এ ব্যাপারে মোটেও উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে না।

তারা ইতোমধ্যে স্রেফ বলে দিয়েছে যে, এ মৃত্যুর জন্য তারা দায়ী নয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়, এজন্য তারা দায়ী নন; সেক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাহলে দায়ী কে? কেউ না কেউ তো দায়ী। আর সে দায় চিহ্নিত করে সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই যদি নতুন ধাপে ভোটগ্রহণ অব্যাহত রাখা হয় এবং তাতে আবারও হতাহতের ঘটনা ঘটে, তাহলে সে দায় কার ওপর বর্তাবে?

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের ইতিহাস অনেক পুরোনো। তবে সেটি কত পুরোনো বা কোত্থেকে কীভাবে এর আলোচনা শুরু করা যায়, সেটি ভিন্ন ও বিস্তৃত আধ্যয়নিক (একাডেমিক) প্রসঙ্গ। অত্র নিবন্ধের মূল প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে এখানে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, এ দেশে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচন কখনোই রাজনৈতিক দলভিত্তিক ছিল না। বস্তুত কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে রাজস্ব আদায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সেই মোগল আমল থেকে এ দেশে পঞ্চায়েত প্রথা চালু ছিল। পরে ঔপনিবেশিক শাসনামলে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় বেঙ্গল চৌকিদারি অ্যাক্ট ১৮৭০-এর মাধ্যমে। সেই থেকে নানা নামে ও আঙ্গিকে ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দেড় শতাব্দী এ দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার পদ্ধতি একটি অরাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবেই টিকেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে প্রথমবারের মতো এটি রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে এবং সেই থেকে এ নির্বাচনকে ঘিরে বড় মাত্রার খুনাখুনির শুরু, যার সর্বশেষ চেহারা এখন আমরা অত্যন্ত হতাশা ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয় সরকারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কর আরোপ, বাজেট প্রণয়ন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে একে একটি স্বনির্ভর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০)। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো সরকারই সে অঙ্গীকার পূরণের ধার-পাশ দিয়েও হাঁটেনি। কারণটি বোধগম্য। স্থানীয় সরকারকে স্বনির্ভর ও শক্তিশালী করা হলে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সুযোগ-সুবিধা বহুলাংশে হ্রাস পাবে। ফলে আমলাতন্ত্রের দিক থেকে এ ব্যাপারে কখনোই বিশেষ কোনো আগ্রহ বা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়নি; বরং কখনো কখনো প্রকাশ্য বা গোপন বিরোধিতাও কাজ করেছে। কিন্তু জনমানুষের সঙ্গে অহর্নিশ জড়িয়ে থাকা রাজনীতিকরা কেন এ ব্যাপারে উদ্যোগী ও উৎসাহী হচ্ছেন না, তা বোধগম্য নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, এটি সংবিধানপ্রদত্ত একটি অবশ্য পালনীয় নির্দেশনা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই তা অবিলম্বে বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন।

যা হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়াটা জরুরি কি না? সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার পর এখন প্রায় সবাই বোধকরি একমত হবেন যে, রাজনৈতিক দলভিত্তিক ইউপি নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ে শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক বিরোধই বাড়িয়ে তুলছে না, আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় যে শান্তিপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল, সেটিকেও ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, এতদিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও খুনাখুনির ঘটনা ঘটত, তা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। এগুলোর বিস্তার ছিল বড়জোর উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত। কিন্তু দাঙ্গা-হাঙ্গামাপূর্ণ সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের হাত ধরে এসব এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যেসব গ্রামীণ শিক্ষার্থী সৌভাগ্যবশত এখনো এসব হীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়ায়নি, তাদের ওপরও এর একটি নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি হচ্ছে। এরা এ মুহূর্তে এসবে না জড়ালেও চোখের সামনে এসব ঘটতে থাকলে এর প্রভাবে নিকট ভবিষ্যতে এদের পক্ষেও এ ধরনের হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল নির্দেশিকা হচ্ছে এর সংবিধান। আর সংবিধানে উল্লিখিত অঙ্গীকার ও নির্দেশনাগুলো কোন রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে, তা নির্ধারণের জন্যই আইন পরিষদের (জাতীয় সংসদ) আদর্শিক সদস্য খুঁজতে দলভিত্তিক নির্বাচন। এর বাইরে অন্যান্য নির্বাচনও দলভিত্তিক হওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বহু শতাব্দীর পথপরিক্রমা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বাংলাদেশের সমাজে মানুষের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি এরূপ কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই গড়ে উঠেছে যে, সেখানে রাজনৈতিক আদর্শ কখনোই মুখ্য হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে স্বভাবতই লক্ষ করা গেছে, দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত ২০১৫-পরবর্তী দুটি ইউপি নির্বাচনের কোনোটিতেই (দ্বিতীয়টি এখনো শেষ হয়নি) সাধারণ মানুষ মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি; বরং এ নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে এবং বহু ক্ষেত্রে তা বিরাজমান সামাজিক সম্পর্ককেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বিগত ৫০ বছরে দেশ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বেশকিছু সামাজিক সূচকে লক্ষ্যযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হলেও সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির গুণগত মানের ক্ষেত্রে আমরা অনেকখানিই পিছিয়ে পড়েছি। এ অবস্থায় ইউপি নির্বাচনকে দলভিত্তিক করতে গিয়ে সে সামাজিক সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে দেওয়াটা মোটেও সমীচীন হবে না। এমতাবস্থায় চলতি নির্বাচনের পর আর কোনো ইউপি নির্বাচন দলভিত্তিক না হওয়াটাই দেশ ও সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করি। আর সে লক্ষ্যে ২০২৬ সালে অনুষ্ঠেয় ইউপি নির্বাচনের অনেক আগেই যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন আনয়নে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ও নির্বাহী কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসবেন বলে আশা রাখি।

আবু তাহের খান : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

[email protected]