অবিশ্বাস্য সব অঘটন, রোমাঞ্চ-উত্তেজনার নানা অলিগলি পেরিয়ে শেষ ধাপে কাতার বিশ্বকাপ। ফাইনালের মঞ্চে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। সোনালী ট্রফিটি উঁচিয়ে ধরবেন লিওনেল মেসি কিংবা উগো লরিস। দ্বিতীয় জনের জন্য এই স্বাদ যদিও প্রথম নয়, তবে প্রথম জনের এখনও অধরা।
দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের এই দুই দল ফাইনালে ওঠায় একটি ব্যাপার অবশ্য নিশ্চিত হয়ে গেছে- নিজেদের তৃতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি জিতবে যে কোনো এক দল।
ব্রাজিলের পাঁচবার, জার্মানি-ইতালির চারবার, আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স-উরুগুয়ের দুইবার, ইংল্যান্ড-স্পেনের একবার। বিশ্বকাপ জয়ের ক্ষেত্রে শুধু ৩ সংখ্যাটিই ফাঁকা পড়ে আছে। সেটিও এবার পূর্ণ হচ্ছে।
কাতারের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম, লুসাইল স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি শুরু হবে রোববার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়।

ফ্রান্স তাদের দুই শিরোপার সবশেষটি পেয়েছে চার বছর আগেই। আর আর্জেন্টিনা? সেই ১৯৮৬ সালে দিয়েগো মারাদোনার হাত ধরে এসেছিল তাদের দ্বিতীয় শিরোপা। এরপর একে একে আটটি আসরে শুধু অপেক্ষাই দীর্ঘ হয়েছে তাদের। হারের বিষাদ সঙ্গী হয়েছে মাঝে দুটি ফাইনালেও। ৩৬ বছরের আক্ষেপ ঘোচাতে প্রয়োজন স্রেফ একটি জয়।
এবারের বিশ্বকাপেও আসে তারা টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে। সেই যাত্রা থেমে যায় প্রথম ম্যাচেই, সৌদি আরবের বিপক্ষে অভাবনীয় হারে। তাদের জন্য হারটা যেন ছিল জ্বলে ওঠার জ্বালানী। এরপরই যে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায় আলবিসেলেস্তেরা। টানা পাঁচ জয়ে পা রাখে শেষের মঞ্চে। যেখানে জাদুকরী পারফরমান্সে সামনে থেকে দলকে পথ দেখান অধিনায়ক মেসি।
মেক্সিকোর বিপক্ষে ৬৪তম মিনিটে মেসির চমৎকার ওই গোলটিই লিওনেল স্কালোনির দলের সবকিছু বদলে দেয়। সেই থেকে দল হিসেবে তারা হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী। মেসি তার নিজের খেলাকে নিয়ে যান অন্য পর্যায়ে।
আর্জেন্টিনার এই আসরের পথচলা অনেকটা মিলে যায় ১৯৮৬ সালে তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া কিংবা ১৯৯০ আসরে ফাইনালে খেলার সঙ্গেও।
মেক্সিকো আসরে একক নৈপুণ্যে দলকে শিরোপা জেতান মারাদোনা। নকআউট পর্বের প্রতিটি ধাপে তিনি উপহার দেন ম্যাচ জয়ী পারফরম্যান্স। চার বছর পরের আসরে প্রথম ম্যাচ হারের পরও তারা ফাইনালে উঠে হেরে যায় তখনকার পশ্চিম জার্মানির কাছে।

এবার নকআউটের প্রথম তিন ধাপে অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মেসি-জাদু ছিল ছিয়াশির মারাদোনার মতোই।
নিজের প্রথম চার বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে ৮ ম্যাচ খেলে মেসির কোনো গোল ছিল না। এবার শেষ ষোলো, কোয়ার্টার-ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল, তিন ম্যাচেই একবার করে জালের দেখা পান ৩৫ বছর বয়সী তারকা। সব মিলিয়ে এই আসরে তার গোল ৫টি, ফাইনালের প্রতিপক্ষ কিলিয়ান এমবাপের সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ।
এই বছর দেশের হয়ে ১৩ ম্যাচে মেসির গোল ১৬টি। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে তার পারফরম্যান্স।
এমন চোখধাঁধানো পরিসংখ্যান আর পারফরম্যান্স তিনি উপহার দিয়েছেন ক্যারিয়ার জুড়েই। ক্লাব পর্যায়ে জিতেছেন সবকিছুই। জাতীয় দলের জার্সিতে একটি শিরোপার যে আক্ষেপ ছিল, সেটিও ঘুচে গেছে গত বছর কোপা আমেরিকা জিতে।
আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ স্কোরার তিনি অনেক আগে থেকে। গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপে দেশের সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটিও নিজে করে নিয়েছেন এইবার। ফাইনালে মাঠে নামলেই লোথার মাথেউসকে ছাড়িয়ে বিশ্ব মঞ্চে সবচেয়ে বেশি ২৬ ম্যাচ খেলার রেকর্ড হয়ে যাবে তার একার।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিটাই শুধু জেতা হয়নি তার। এই ফাইনালই বিশ্বকাপে শেষ, মেসি ঘোষণা দিয়েছেন আগেই। সাবেক সতীর্থের উপলক্ষটা রাঙিয়ে তুলতে চান কোচ স্কালোনি।

“যদি এটি লিওর (মেসি) শেষ ম্যাচ হয়, শিরোপা জয় দিয়ে আমরা উপলক্ষটা রাঙাতে পারব বলে আশা করি। তা করতে পারলে দারুণ হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ম্যাচটি উপভোগ করতে হবে। বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার চেয়ে ভালো দৃশ্য আর কী হতে পারে।”
এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শক্তির বড় একটি উৎস হলো তাদের সমর্থক। প্রতিটি ম্যাচের আগে-পরে সমর্থকরা যেভাবে নেচে-গেয়ে, গলা ফাটিয়ে সমর্থন দিয়ে গেছে, অনেক বড় ব্যাপার। গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেসের কথায়ও সেটি স্পষ্ট, “প্রতিটি ম্যাচে মনে হয়েছে আমরা ঘরের মাঠে খেলছি।”
সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে স্রেফ গুঁড়িয়ে দেওয়া আর্জেন্টিনার কাজটা ফাইনালে যে সহজ হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চার বছর আগের বিশ্বকাপে শেষ ষোলোয় ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরেই থেমে গিয়েছিল তাদের পথচলা।
শক্তিতে ততটা দুর্বার যদিও এবার নয় ফ্রান্স। আসর শুরুই করে তারা অনেক শঙ্কার দোলাচলে। রাশিয়া আসরে শিরোপা জয়ে মাঝমাঠে বড় অবদান ছিল যাদের, সেই পল পগবা ও এনগোলো কঁতেকে চোটের কারণে এবার পাননি কোচ দিদিয়ে দেশম। একই কারণে ছিটকে যান প্রেসনেল কিম্পেম্বে, করিম বেনজেমা ও ত্রিস্তোফা এনকুনকু। প্রথম ম্যাচে হারাতে হয় লুকাস এরনঁদেজকেও।
সেই ম্যাচে ৯ মিনিটেই ফরাসিদের জালে বল পাঠিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। শেষ পর্যন্ত যদিও বড় জয়েই আসর শুরু করে শিরোপাধারীরা।
আর্জেন্টিনার মতো অঘটনের শিকার হতে হয় ফরাসিদেরও। প্রথম দুই ম্যাচ জিতে শেষ ষোলোর টিকেট নিশ্চিতের পর নিয়মিতদের অনেককে বিশ্রাম দিয়ে তারা হেরে বসে তিউনিসিয়ার কাছে।
এরপর নকআউটে পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও মরক্কোকে হারিয়ে ফ্রান্স উঠে আসে ফাইনালে। এই ধাপে যে দুটি গোল তারা হজম করেছে, দুটিই পেনাল্টি থেকে।
আক্রমণভাগের বড় অস্ত্র এমবাপে নকআউটে কোনো গোল করতে পারেননি। তবে গ্রুপের তিন ম্যাচেই তিনি করে ফেলেন ৫ গোল। এখনও পর্যন্ত ৪ গোল করে বড় অবদান রেখেছেন এই আসর দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে যাওয়া অলিভিয়ে জিরুদ। আর ফরোয়ার্ড অঁতোয়ান গ্রিজমান এবার সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে সুর বেঁধে দিচ্ছেন মাঝমাঠে।

ভাইরাসজনিত কারণে বেশ কয়েজন খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে পড়ায় ফাইনালের আগে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল দেশমের কপালে। তবে শনিবার অনুশীলনে ফেরেন তারা সবাই। দলেও ফেরে স্বস্তির হওয়া।
ফ্রান্সকে ডাকছে ইতিহাস। ইতালি (১৯৩৪, ১৯৩৮) ও ব্রাজিলের (১৯৫৮, ১৯৬২) পর দ্বিতীয় দল হিসেবে টানা দুটি বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি তাদের সামনে। প্রথম অধিনায়ক হিসেবে এই কীর্তি গড়ার সুযোগ লরিসের। ইতালিকে তাদের প্রথম দুটি বিশ্বকাপ টানা জেতানো ভিত্তোরিও পোৎসোর পর প্রথম কোচ হিসেবে এই অর্জনের হাতছানি দেশমের সামনে।
কোনটা শেষ পর্যন্ত বাস্তব হয়ে ধরা দেবে? টানা দুটি ট্রফি জয়ের উল্লাসে মাতবে ফ্রান্স নাকি মেসি ও আর্জেন্টিনার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটবে?
উত্তর মিলবে রাতে!